আয়ের দেড় গুণ ব্যয় বিকেবি-রাকাবের
নিউজ ডেস্ক:
২০১৪ সাল পর্যন্তও ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি ছিল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব)। পরের বছর থেকেই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যায় ব্যাংক দুটির। সর্বশেষ গত বছরও তারা ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে প্রায় ১৫০ টাকা খরচ করেছে। অর্থাৎ বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকই আয়ের দেড় গুণ ব্যয় করেছে।
এ কারণে লোকসানের অংকও বড় হচ্ছে ব্যাংক দুটির। লোকসান বেড়ে যাওয়ায় রেকর্ড ৮ হাজার কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বিকেবি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি। আর রাকাবের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৭৫ কোটি টাকা। যদিও প্রায় প্রতি বছরই সরকার থেকে মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে ব্যাংক দুটিকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকেবি ও রাকাবের কস্ট অব ফান্ড প্রায় ১০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে হচ্ছে। এতে প্রতি ১০০ টাকায় ১ টাকা পরিচালন লোকসান দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিচালন অদক্ষতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণের নামে অর্থ লোপাট। এতে ব্যাংক দুটির আর্থিক বিপর্যয়ও তীব্র হচ্ছে।
তবে লোকসান করলেও ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে দাবি করেন কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দুই বছর আগে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৮ শতাংশ। বর্তমানে তা ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। কস্ট অব ফান্ডের চেয়ে কম সুদে ঋণ বিতরণ করায় লোকসান ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১০ সালে বিকেবি ও রাকাবের ১০০ টাকা আয় করতে ৮৭ টাকা ৮০ পয়সা ব্যয় হয়েছে। এর পর থেকেই বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের ব্যয়-আয়ের অনুপাত বাড়ছে। ২০১১ সালে আয়কৃত অর্থের ৮৮ দশমিক ৬, ২০১২ সালে ৯১ দশমিক ২, ২০১৩ সালে ৯৪ দশমিক ৮, ২০১৪ সালে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয়। ২০১৫ সাল থেকে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে ১১৩ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৬ সালে ১০০ টাকা আয় করতে ১৩৭ দশমিক ৮ টাকা ও ২০১৭ সালে ১২৪ টাকা ব্যয় হয় ব্যাংক দুটির। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ১০০ টাকা আয় করতে ১৪৯ টাকা ৯০ পয়সা ব্যয় করতে হয়েছে ব্যাংক দুটিকে। যদিও একই বছর দেশের বিদেশী ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আয় করতে ব্যয় করেছে মাত্র ৪৪ দশমিক ৩ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ অনুপাত ছিল ৭৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
কৃষি ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮০০ কোটি টাকার বেশি পরিচালন লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি। খেলাপি ঋণ কমায় সঞ্চিতি থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ আয়ের খাতে দেখানো হয়েছে। এতে গত অর্থবছরে ব্যাংকটির নিট লোকসানের পরিমাণ ৬২৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৪৬ কোটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৭৮ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান দিয়েছে কৃষি ব্যাংক। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪৭ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৯৬ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান দিয়েছিল ব্যাংকটি।
ধারাবাহিক লোকসানের কারণে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে কৃষি ব্যাংক। ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে কৃষি ব্যাংকে আমানত ছিল ২৪ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। একই সময় ২০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি।
এ প্রসঙ্গে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, কৃষি ব্যাংক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের মাঝে ঋণ বিতরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণের জন্য আমরা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ আদায় করতে পারি। কিন্তু কৃষি ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডই হচ্ছে ১০ শতাংশের বেশি। ১০০ টাকার ঋণ বিতরণ করলে শুরুতেই আমাদের ১ টাকা লোকসান গুনতে হয়। খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য পরিচালন ব্যয় হিসাবায়ন করলে এ লোকসানের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
ধারাবাহিক লোকসানের কারণে কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে হলে আমাদের গ্রামাঞ্চলে ঋণ বাড়াতে হবে। এখন চাষাবাদে ঋণ দেয়ার চেয়ে কৃষিভিত্তিক শিল্পে ঋণ বিতরণ বাড়ানো দরকার। আমরা চাই, আগামী ২০ বছরের মধ্যে কৃষি ব্যাংকের ঋণস্থিতি ৬০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হোক। ঋণের স্থিতি বাড়লে কস্ট অব ফান্ড কমে আসবে। ব্যাংকও মুনাফায় ফিরতে পারবে।
এদিকে বর্তমানে লোকসানে না থাকলেও রাকাবের মূলধন ঘাটতি ৭৭৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকটির ৩৮১টি শাখার মধ্যে ৬৪টিই লোকসানি। আমানতের চেয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করে বিপদে আছে ব্যাংকটি। ডিসেম্বর শেষে রাকাবের আমানত ছিল ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। যদিও একই সময় ব্যাংকটি ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে ফেলেছে। এডি রেশিও শতভাগ অতিক্রম করায় ব্যাংকটিকে সতর্ক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।