প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠি: রামপাল চুক্তি ছুড়ে ফেলো, সুন্দরবন রক্ষা করো

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা আপনার অবগতির জন্য দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা এবং দেশে বিভিন্ন গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সারসংক্ষেপ নিচে পেশ করছি:

১. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এ ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূত ছাই বা স্লারি ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে। কারণ এতে আর্সেনিক ও বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন— পারদ, সিসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, বেরিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। ফলে সুন্দরবনের পশুপাখি-বৃক্ষ-লতাপাতাসহ অসংখ্য প্রাণ ও ইকোসিস্টেম ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। ২. কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিষাক্ত সালফার ও নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের ফলে মানুষ-গাছপালা-জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে। ৩. সাড়ে চার বছর ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকালে আমদানি করা কয়লাসহ নির্মাণের পণ্য ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদীপথে পরিবহন করার সময় বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ, ড্রেজিং ইত্যাদির মাধ্যমেও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত পরিবহন করার কারণে কয়লার জাহাজ থেকে নির্গত কঠিন ও তরল বর্জ্য, জাহাজের শব্দ, জাহাজসৃষ্ট ঢেউ, সার্চ লাইটের আলো, কয়লা লোড-আনলোডের ফলে সৃষ্ট দূষণ ইত্যাদিতে সুন্দরবনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। ৪. কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রেসার, পাম্প, কয়লা ওঠানো-নামানো, পরিবহন ইত্যাদি কাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি ও যানবাহন থেকে ভয়াবহ শব্দদূষণ হবে। ৫. কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত দূষিত পানি এবং অন্যান্য কঠিন ও তরল বর্জ্য সুন্দরবনের পশুর নদ ও সংযুক্ত খালগুলোর পানি দূষিত করে ফেলবে। যেসব নদী সুন্দরবনের প্রাণ, সেগুলোর অবস্থা বুড়িগঙ্গার চেয়েও খারাপ হবে। ফলে সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চাইছে, সেই ভারতেরই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ‘ইআইএ গাইড লাইন, ২০১০’-এ স্পষ্ট বলা আছে— নগর, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা ইত্যাদির ২৫ কিলোমিটার সীমার মধ্যে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এড়িয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ ভারতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলে সুন্দরবনের ঘাড়ে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, তা ভারতের আইনে অবৈধ। সেজন্য ভারতের সজাগ মানুষও ক্রমে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন।

১৪ কিলোমিটার দূরত্বসীমা যে মোটেই নিরাপদ কোনো দূরত্বসীমা নয়, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলেও স্পষ্ট বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ফায়েত্তি কাউন্টিতে ১৯৭৯-৮০ সালে ১ হাজার ২৩০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সময়ও স্থানীয় মানুষকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। পেকান বৃক্ষগুলো (এক ধরনের শক্ত বাদাম, কাজু বাদামের মতো) যখন একে একে মরতে শুরু করল তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের হিসাবে ফায়েত্তি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস বিশেষত সালফার ডাই-অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় পেকান, এলম, ওকসহ বিভিন্ন জাতের গাছ আক্রান্ত হয়েছে, বহু পেকান বাগান ধ্বংস হয়েছে এবং এই ক্ষতিকর প্রভাব কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এমনকি ৪৮ কিলোমিটার দূরেও পৌঁছে গেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনার বিভিন্ন কর্মকর্তা বলছেন, রামপালে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে ফলেসুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না

আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, তাপীয় কর্মদক্ষতা বা ইফিসিয়েন্সি অনুসারে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন প্রকার: সাব ক্রিটিক্যাল, সুপার ক্রিটিক্যাল ও আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল। সাব ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ন্যায় সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, পারদ, সিসা, আর্সেনিক মিশ্রিত বিষাক্ত ছাই ইত্যাদি নির্গত হয়। সাব ক্রিটিক্যাল টেকনোলজির তুলনায় সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করলে দূষণের পরিমাণ মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ হ্রাস পায়, যা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ দূষণ সামান্যই কমাতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে টেকনোলজিই ব্যবহার করা হোক, বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে শব্দদূষণ হবেই, বিদ্যুৎকেন্দ্র শীতল রাখার জন্য পশুর থেকে পানি গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। ফলে ঢাকার বুড়িগঙ্গার চেয়েও সুন্দরবনের পশুর নদে আরো ভয়াবহ দূষণ ঘটবে। শব্দদূষণ, পানিদূষণ, আলোদূষণ ইত্যাদি ঘটবেই।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ সমীক্ষায় শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু থাকলে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে তার হিসাব করা হয়েছে, এর সঙ্গে ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হলে কী প্রভাব পড়বে তার কোনো হিসাব করা হয়নি। আর ওরিয়ন গ্রুপ তো পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়াই ২০০ একর জমি কিনে মাটি ভরাট করে ফেলেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

কোম্পানি মন্ত্রণালয়ের লোকজন প্রায়ই দাবি করে যে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি ব্যবহার করা হবে, তাতেকোনো দূষণ ঘটবে না আর বছরে মাত্র তিন মাস বাতাস উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেসুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না

প্রথমত. চিমনির উচ্চতা বাড়ালে দূষণকারী উপাদানের পরিমাণ কমে যায় না বা দূষণ মহাশূন্যে চলে যায় না। বাতাসের প্রবাহ শক্তিশালী থাকলে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে প্রবাহিত হয় এবং প্রবাহ দুর্বল থাকলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছের বাতাসই দূষিত করতে থাকে। দ্বিতীয়ত. সরকারি পরিবেশ সমীক্ষা অনুযায়ীই তিন মাস নয়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি— এই চার মাস ধরে বাতাস উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবে। সুন্দরবনের বিপর্যয়ের জন্য এই চার মাসই যথেষ্ট। তাছাড়া ঘূর্ণি বাতাস, ঝড়সহ নানা কারণেই এই চার মাস ছাড়াও বছরের অন্য সময়েও বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হতে পারে। তৃতীয়ত. বাকি আট মাস ধরে বিষাক্ত বাতাস দক্ষিণ থেকে উত্তরে অর্থাৎ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে খুলনা-বাগেরহাট শহরের দিকে প্রবাহিত হবে, যা খুলনা-বাগেরহাটের জনবসতির জন্য বিপর্যয়কর হবে। কারণ খুলনা-বাগেরহাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপদসীমার মধ্যে পড়েছে। চতুর্থত. কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ শুধু বায়ুবাহিত নয়, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানিদূষণ, শব্দদূষণ, ছাইয়ের দূষণ, কয়লা পরিবহনের কারণে দূষণ সারা বছর ধরেই ঘটবে, যেগুলোর সঙ্গে বাতাসের দিকের কোনো সম্পর্ক নেই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনি অনেকবারই বলেছেন, বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তো কোনো পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না, তাহলে রামপালকয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পরিবেশ দূষণ হবে কেন? আপনি কিছুদিন আগে রকমও বলেছেন যে, কয়লা দিয়ে পানি বিশুদ্ধকরা হয়, সুতরাং এখানে কীভাবে ক্ষতি হবে?

আপনার চারধারে অনেক ডিগ্রিধারী লোক থাকলেও তারা আপনাকে যে ভুল তথ্য ও ধারণা দিয়ে দেশী-বিদেশী কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করছে, তা এতেই পরিষ্কার হয়। বাস্তবে যে কেউ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশে গেলেই দেখতে পাবেন পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ উদাহরণ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশের কৃষিজমি কয়লাদূষণে রীতিমতো কালো রঙ ধারণ করেছে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে গেছে, ছাইয়ের পুকুরে গাদা করে রাখা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে, ফসল ও মাছ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত. বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনা সঠিক নয়। কারণ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র ছোট আকারের এবং বড়পুকুরিয়ার পাশে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর বিশ্ব ঐতিহ্য বনাঞ্চল নেই। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট, যার মধ্যে আবার কার্যত ১২৫ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটই কেবল চালু থাকে। অথচ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, যা বড়পুকুরিয়ার কার্যকর (১২৫ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ গুণেরও বেশি। ফলে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে তার ১০ গুণেরও বেশি ক্ষতি হবে। তৃতীয়ত. আপনার উপদেষ্টারা আপনাকে কাঠ কয়লা ও খনিজ কয়লার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করেনি। তাদের হাতেই জিম্মি হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন, এটা আমাদের উদ্বেগের একটি বড় কারণ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

সরকার থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত ছাই বাতাসে ছড়াবে না এবং এই ছাই সিমেন্ট কারখানা, রাস্তাঘাটনির্মাণ ইত্যাদি কাজে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হবে

‘কিছু উড়ন্ত ছাই’ বাতাসে মিশবে বলে স্বীকার করা হয়েছে খোদ ইআইএ রিপোর্টেই। আবার যে বিষাক্ত ছাই পরিবেশে মিশবে না বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে, সেই ছাই দিয়েই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা ১ হাজার ৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১ হাজার ৪১৪ একর ভরাট করা হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এভাবে ছাই দিয়ে জমি ভরাট করা হলে ছাইয়ের মধ্যে থাকা আর্সেনিক, পারদ, সিসা ইত্যাদি বিষাক্ত ভারী ধাতু বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে, চুইয়ে মাটির নিচের এবং মাটির উপরের পানি দূষিত করবে; যা সুন্দরবনকে বিপর্যস্ত করবে।

আর ছাইয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তা মিথ্যা আশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দৈনিক মাত্র ৩০০ টন বর্জ্য ছাই উৎপাদিত হয়। এগুলো ছাইয়ের পুকুরে গাদা করে রেখে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২ লাখ ৬০ হাজার ৬১৩ টন ছাই পুকুরে জমা করে পুকুরের প্রায় পুরোটাই ভরে ফেলা হয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও পশুর নদের একেবারে পাশে ১০০ একরের ছাইয়ের পুকুরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ছাইয়ের পুকুরে গাদা করে রাখা ছাই বাতাসে ওড়ে, ছাইমিশ্রিত পানি চুইয়ে মাটির নিচে এবং আশপাশের নদী ও জলাভূমিতে বিষাক্ত ভারী ধাতুর মারাত্মক দূষণ ঘটাবে।

ভারতে এনটিপিসির বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই কীভাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পানি ও খাদ্য উৎপাদন বিপর্যস্ত করছে, তা সরেজমিনে দেখে এসেছে জাতীয় কমিটির এক প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশ পানিপ্রধান ও উর্বর জমির দেশ বলে আর আলোচ্য কেন্দ্রের পাশে সুন্দরবন আছে বলে এ ক্ষতির মাত্রা আরো বহুগুণ বেশি হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদ দিয়ে তো এমনিতেই অনেক জাহাজ চলাচল করছে তাহলেকয়লাভর্তি জাহাজ চলাচল করলে কী সমস্যা? তাছাড়া কয়লার জাহাজে পুরোপুরি ঢেকেই কয়লা পরিবহন করা হবেতাহলে পরিবেশ দূষণ হবে কীভাবে?

সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে যে জাহাজ চলাচল করছে, সেগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট, কয়েকশ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। সেগুলোর প্রভাবে এরই মধ্যে সুন্দরবনের ক্ষতি হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে কয়লা ও তেলবাহী এ রকম জাহাজের একাধিক দুর্ঘটনায় অপরিমেয় দীর্ঘকালীন ক্ষতি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। এমনকি আপনিও এ পথে জাহাজ চলাচল বন্ধ করার কথা বলেছেন। অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে: ‘সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চালু হওয়া নৌপথের কারণে পূর্ব সুন্দরবন প্রাণীশূন্য হতে শুরু করেছে। প্রতিদিন প্রায় ১৫০টি বিশাল আকৃতির নৌযান বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এসব নৌযানের ঢেউ, ফেলে যাওয়া বর্জ্য, তেল ও শব্দদূষণের কারণে বনের দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বৃক্ষ, লতা, গুল্ম মরতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বনের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’

সাধারণ নৌযান চলাচলের ফলেই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে দূষণকারী কয়লাভর্তি বড় বড় জাহাজ চলাচল করলে কিংবা সেই কয়লাভর্তি জাহাজ যদি কখনো ডুবে যায় তখন সুন্দরবনের কী অবস্থা হবে, তা চিন্তা করাও ভীতিকর। আর কয়লা যতই ঢেকে পরিবহন করা হোক কিংবা জাহাজের গতি যতই নিয়ন্ত্রণ করা হোক, তাতে জাহাজের কয়লাস্তূপ থেকে চুইয়ে পড়া কয়লা-ধোয়া বিষাক্ত পানি (বিলজ ওয়াটার), অ্যাংকরেজ পয়েন্টে কয়লা লোড-আনলোড করার সময় সৃষ্ট দূষণ, কয়লার গুঁড়ো, জাহাজ-নিঃসৃত তেল-আবর্জনা, জাহাজ চলাচলের শব্দ, ঢেউ, বনের ভেতরে জাহাজের সার্চ লাইটের তীব্র আলো, জাহাজের ইঞ্জিন থেকে নির্গত বিষাক্ত সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাস ইত্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব দূর হয়ে যায় না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনি বলেছেন, কোম্পানির লোকজনও বলেছে, অক্সফোর্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে,সেগুলোয় কোনো ক্ষতি হয় না এটাতে কেন হবে

প্রকৃত তথ্য হলো, অক্সফোর্ডে Didcot নামের একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয় ১৯৭০ সালে যখন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ নিয়ে সচেতনতা আজকের পর্যায়ে ছিল না। কিন্তু কয়লা বিদ্যুতের দূষণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আন্দোলনের কারণে অক্সফোর্ডের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০১৩ সালের মার্চে বন্ধ করে দেয়া হয়। অক্সফোর্ড ছাড়া যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলা হয়, সেগুলো সম্পর্কে যে কেউ খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মানুষ ও প্রকৃতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে নির্মিত থাইল্যান্ডের Mae Moh কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে হাজার হাজার মানুষ ফুসফুসের অসুখে ভুগেছে, চারপাশের কৃষি অঞ্চলে ফসলের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জলাভূমিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের দূষণ ঘটেছে। ভিয়েতনামের Quang Ninh কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের সময় বিপুল পরিমাণ কয়লা দিয়েন ভং নদীতে ভেসে গেছে, ব্যাপক নদীদূষণ ঘটেছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরো কিছু কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হা লং বে’ও মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে। ছবিতে যেমনই দেখা যাক, তাইওয়ানের Taichung কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দুনিয়ার অন্যতম দূষণকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বলা হয়। এ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে তাইওয়ানের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে বায়ুদূষণ এত বেড়েছে যে, এক পর্যায়ে আন্দোলনের মুখে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে আর চারপাশের পানি ও বাতাস দূষিত হবে না, মানুষ ও প্রকৃতির দূষণ ঘটবে না— কারিগরিভাবে এটা এখনো অসম্ভব। আশা করি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চকচকে ছবি দেখে আপনি বিভ্রান্ত হবেন না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবন এক অমূল্য সম্পদ। আমরা সুই থেকে রকেট সবই তৈরি করতে পারব, কিন্তু এ রকম অসাধারণ জীববৈচিত্র্যভরা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন আরেকটি তৈরি করতে পারব না। এ সুন্দরবন আমাদের বিপুল সম্পদ জোগান দেয়। এ সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে, জীববৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার হিসেবে আমাদের সবার প্রাণ সমৃদ্ধ করে। এই বন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের প্রধান অবলম্বন। এই বন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রধান শক্তি। সেজন্যই আমরা বারবার বলি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। আজ শুধু এর রক্ষা নয়, এর বিকাশে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা। [বাকি অংশ আগামীকাল]

 

চিঠি প্রদানকারী যথাক্রমে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সদস্য সচিব