শুরু হোক পবিত্র রমজানের প্রস্তুতি

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসছে পবিত্র শা’বান মাস। বাকি আর মাত্র কয়েক দিন। আসছে পবিত্র রোজা তারাবীহ, সাহ্‌রী ও ইফতারের মতো বিবিধ আনন্দঘন আমলের আনন্দে পরিপূর্ণ পবিত্র একটি মাস। মহিমান্বিত মাস পবিত্র রমজান, আত্মশুদ্ধির মাস।  এ মাসের প্রথম ১০দিনে খুলে দেওয়া হয় রহমতের সব দরজা। দ্বিতীয় ১০দিনে খোদা তা’য়ালা খুলে দেন মাগফিরাতের দরজা। এবং তৃতীয় ১০ দিনে খুলে নাযাতের দরজা। পুরো মাসে জিঞ্জির দিয়ে বেধে রাখা ইবলিশ শয়তানকে। এ মাসকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছা করলেই যেকোনো মুসলমান নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন। অর্জনের খাতায় লুফে নিতে পারেন দুনিয়া ও পরকালের কামিয়াবী।

আর তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত পরষ্পর পরষ্পরকে সাহয্য সহযোগীতা করা। এ লক্ষ্যে অধীনস্ত কর্মচারীদের কাজের চাপ কমিয়ে দেয়া, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ কমিয়ে দেয়া, পরিবারের সদস্যদের সহযোগীতা করা। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।” (পবিত্র সূরা মায়েদা: আয়াত নং ২) এখানে উল্লেখ্য, পড়াশোনা করা, পরীক্ষা দেয়া, চাকরি-ব্যবসা করা কিন্তু গুণাহ ও জুলুমের কাজ না কিন্তু রমজান মাস হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জনের মাস, মহান আল্লাহর তরফ থেকে মনোনিত খাস সময়. তাই এমাসে তাক্বওয়া অর্জনকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এই একমাসের অর্জিত তাক্বওয়া-পরহেজগারীতাই আগামী ১১ মাস হক্ব-হালালভাবে চলার পাথেয়।

কিতাবাদিতেও আমরা দেখতে পাই বর্ণিত রয়েছে,  “যে ব্যক্তি পবিত্র রমজান মাসে নিজের অধীনস্থদের কাজের চাপ কমিয়ে দেয়, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।” (শুআবুল ঈমান)

পবিত্রতা, আত্মশুদ্ধি এবং উদার মানসিকতার মধ্যেই তো প্রকৃত শান্তি। অফুরন্ত এই শান্তি অর্জনে, যথাযথভাবে পবিত্র এ মাসকে পালন করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। রাসুল (সা.) শাবান মাসকে রমজান মাসের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস বলেছেন। সারা বছরের পাপ-অনিষ্টতা দূর করে নিজেকে নিষ্কলুষ করার উত্তম সময় পবিত্র এই রমজান। রোজা, তারাবি এবং দীর্ঘ রজনী ইবাদতে কাটিয়ে দিতে এখনই তাই শুরু হোক আপনার প্রস্তুতি।

মানসিক প্রস্তুতি : যেকোনো কাজের জন্য প্রথমে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। নিয়তের গরমিল থাকায় অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজও অবহেলায় পড়ে থাকে। সওয়াব না এসে অর্জিত হয় পাপ। নিয়ত এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নিয়তের ওপর কাজের প্রতিদান নির্ভরশীল।’ তাই একজন মুসলিম হিসেবে রমজান মাস এবং রোজার ব্যাপারেও আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেকে রোজা রাখেন ঠিকই, কিন্তু দিনের বেলায় খাবার সামনে দেখে আত্মলালসায় ভোগেন। এটা ঠিক নয়। এ ধরনের কাজ, সব ধরনের লোভ ও অহংকার পরিত্যাগ করে মনোবল দৃঢ় করতে হবে এবং মানসিকভাবে রোজার প্রস্তুতি নিতে হবে।

শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি: আমাদের দেশ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার পরেও দেখা যায় পবিত্র রমজানে শিক্ষার্থীদের উপর পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়া হয়। ফলে সে রোজা রাখবে, নাকি পড়াশোনা করবে? পেটে ক্ষুধা নিয়ে পড়াশোনা করা, পরীক্ষা দেয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের উচিত রমজান মাস আসার আগেই সকলে মিলে যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন জানানো যে, পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে যেন তাদের একমাস ছুটি দেয়া হয়। এ দাবি পূরণ হলে শিক্ষার্থীরা বাসায় দ্বীনী শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে, ইবাদত বন্দেগী করার সুযোগ পাবে, চরিত্র গঠন করার সুযোগ পাবে। এমনকি যে ছাত্রটি অসৎসঙ্গের কারণে মাদকতার দিকে ঝুকে যেত, কিংবা নারী সংঘটিত অপরাধে জড়িয়ে পরতো সেই ছাত্রটিই দেখা যাবে পবিত্র রমজানে একটু ইবাদত বন্দেগী করার বা ঠিকমতো রোজা রাখার সুযোগ পাওয়ায় তার জীবনটাই আলোর পথে ঘুরে গেছে।

শ্রমিকদের রোজার প্রস্তুতি : শ্রমিকরা সারা বছরই শ্রমিক। রমজানেও নিশ্চয়ই তাদের কাজ ছাড়ার ফুরসত থাকবে না। তবে ইসলাম এ ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা রেখেছে। তা হলো, রমজানে ভারী কোনো কাজ না করা। আর এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন মালিকের সহমর্মিতা। দিনমজুরদের জন্য ভালো হয় রোজার আগেই বাড়তি কিছু রোজগার জমিয়ে রাখা, যাতে রোজার দিনগুলোতে বাড়তি চাপ না আসে। আর যাদের কাজ ছাড়া কোনো উপায় নেই, তাদের এই মাসে কম কাজ করা উচিত। আর মালিক শ্রেণীকে ইসলাম এ ক্ষেত্রে সহমর্মিতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে- রমজান মাস এলে মালিকরা যেন শ্রমিকদের কাজের চাপ কমিয়ে দেয়।

ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি : রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। সুযোগে মুনাফা করে নেন বছরের দ্বিগুণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি ফায়দা লোটার ধান্ধায় মত্ত থাকে সব সময়। ফলে ভালো পণ্যগুলো থাকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এটা শুধুই অমানবিক নয়, রীতিমতো হিংস্রতাও। এ ব্যাপারে হাদিসে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। রাসুল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন, ‘কেউ যদি কৃত্রিম উপায়ে অর্থাৎ খাদ্য গুদামজাত করে সংকট সৃষ্টি করে, তাহলে আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ দেবেন কিংবা একদিন না একদিন অবশ্যই গরিব বানাবেন।’ রাসুল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এই পবিত্র হাদিস সবসময়ের সময়ের জন্য প্রযোজ্য। আর রমজান মাসে এই বাণীর কার্যকারিতা তো আরো বেশি এবং এই পাপকর্মের শাস্তি আরো বেশি হবে- এমনটাই অভিমত প্রকাশ করেছেন আলেমগণ। অতএব ব্যবসায়ীদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত- দাম বাড়ানোর কারণে যেন কোনো রোজাদার কষ্ট না পান, নিজেরাও যাতে হালাল উপার্জনে রোজা পালন করতে পারেন।

সর্বত্র পবিত্রতা রক্ষা করা : রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা সবার জন্যই কর্তব্য। সবারই খেয়াল রাখা উচিত, তার জন্য যাতে কোনো রোজাদারের ক্ষতি না হয়। পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে রমজানে হারাম গানবাজনা, সিনেমা হল, হোটেল এবং রোজাদারদের জন্য ক্ষতিকর- এমন সব কিছুই বন্ধ রাখা উচিত। পাশাপাশি অশ্লীল কথাবার্তা, শব্দদূষণ ইত্যাদি থেকে নিজেকে পবিত্র রাখতে হবে। সহজ, স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ জীবন সবারই কাম্য। ভাবনাহীন জীবন আর বাড়তি আবেগপ্রবণতা মানুষের জন্য ক্ষতি। তাই আসুন! আসন্ন এই রমজানকে কাজে লাগাই। আত্মঅহংকার ছেড়ে আত্মশুদ্ধির পথ গ্রহণ করি। তবেই শান্তিময় হয়ে উঠবে জীবন।

রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করার ফযিলত:
কিতাবে উল্লেখ আছে যে, একজন বুযূর্গ ব্যক্তি একবার স্বপ্নে দেখেন- এক ইহুদী মহিলা জান্নাতে বিচরণ করছে, খুব আরাম-আয়েশে আছে। বুযূর্গ ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে মহিলা! তুমি তো ইহুদী ছিলে, তুমি কি করে জান্নাতে গেলে? ইসলাম আসার পর ইসলাম গ্রহণ না করে যে সকল বিধর্মী মারা যাবে তারা তো জান্নাতে যেতে পারবে না বরং তারা চির জাহান্নামী হবে।’ জবাবে ইহুদী মহিলা বললো, ‘হে বুযূর্গ ব্যক্তি! মহান আল্লাহ পাক একটি আমলের উসীলায় আমাকে ঈমান দান করেছেন ও ইন্তিকালের পর জান্নাত নছীব করেছেন।’ বুযূর্গ ব্যক্তি বললেন, ‘কোন আমলের উসীলায় তুমি নাজাত পেলে?’ ইহুদী মহিলা বললো, ‘আমার ইন্তিকালের পূর্বে যে রমাদ্বান শরীফ ছিলো সেই রমাদ্বান শরীফ-উনার দিনের বেলায় আমি আমার ছোট সন্তানকে নিয়ে কিছু খাদ্য খরীদ করার জন্য বাজারে যাই। তখন আমার ছোট সন্তানকে কিছু রুটি বিস্কুট কিনে দেই। সে সন্তান রুটি বিস্কুট পেয়ে সাথে সাথে খেতে শুরু করে। যেহেতু সে অবুঝ শিশু। তখন আমি তাকে একটি আঘাত করে বলি, হে বালক! এটা মুসলমানদের পবিত্র মাস। এ মাসে প্রকাশ্যে কিছু খেতে হয় না। এ মাসকে সম্মান করা উচিত।’ এ কথা বলে আমি তার হাত থেকে রুটিটি নিয়ে নেই। ইহুদী মহিলা বললো, পবিত্র রমাদ্বান শরীফকে তা’যীম করার উসীলায় মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাকে ঈমান দান করেন এবং ঈমানের সাথে ইন্তিকাল দান করে জান্নাত নসীব করেন।’ সুবহানাল্লাহ!

এখন ফিকিরের বিষয় যে, একজন অমুসলিম রমাদ্বান শরীফকে তা’যীম করার কারণে যদি তার ঈমান ও জান্নাত নছীব হয়, তবে যদি কোন মুসলমান পবিত্র রমাদ্বান শরীফ-কে তা’যীম বা সম্মান করে, সকল স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা। তবে সে কতটুকু ফযীলত লাভ করবে তা সত্যিই চিন্তা-ফিকিরের বিষয়।

অথচ দু:খের বিষয় যে, আজকাল মুসলমানেরাই পবিত্র রমাদ্বান শরীফ-উনার গুরুত্ব, সম্মান ও পবিত্রতা বুঝে না ও মানে না। তারা রমাদ্বান শরীফ-এ প্রকাশ্যে খানাপিনা করে, বেপর্দা চলে, গান-বাজনা, সিনেমা-নাটক, নোবেল, খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অথচ এসমস্ত হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা সকল মুসলমানের জন্য ফরয-ওয়াজিব।

এখন দেখা যায়- পবিত্র রমাদ্বানেও স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি খোলা রাখা হয়। এবং নানা পরীক্ষা, কোচিং ইত্যাদির নামে ছাত্র-ছাত্রীদের এমন ব্যস্ত রাখা হয় যার ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা অধিকাংশই রোযা রাখে না। অথচ তারা মুসলমান। রোযা তাদের দ্বীনের প্রধান ভিত্তি ও ফরয আমল।

বাংলাদেশ সরকার বিলম্বে হলেও গতবছর রমাদ্বান শরীফ উপলক্ষে মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তথা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে অত্যন্ত প্রশংসামূলক ও ইসলাম সম্মত কাজ করেছে। তাই সরকারের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য হবে এ বছর রমাদ্বান মাসের পূর্ব থেকেই ছুটি ঘোষণা করা এবং এ সিদ্ধান্ত দায়িমীভাবে বলবৎ রাখা।