আলু বেচে খরচ উঠছে না, বিপাকে চাষিরা

কুড়িগ্রাম: এবারও আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। প্রতি মণ আলু চাষে একজন কৃষকের খরচ হয়েছে ৩শ’ ৫০ থেকে ৩শ’ ৮০ টাকা। সেই আলু মণ প্রতি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২শ’ ৪০ থেকে ২শ’ ৬০ টাকায়। এ অবস্থায় লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে আলু চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। চাষিদের ভাষ্য, প্রতি মণ আলুতে তাদের একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা করে লোকসান গুণতে হচ্ছে।

প্রায় আড়াই একর জমিতে আলু চাষ করেছেন জেলার সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের আলু চাষি আরিফ। আলুর বাম্পার ফলন হলেও তার মুখে হাসি নেই। উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি।

আলু চাষি আরিফ জানান, চলতি মৌসুমে জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে জমি থেকে আলু উত্তোলন পর্যন্ত প্রতি মণে খরচ হয়েছে ৩শ’ ৫০ থেকে ৩শ’ ৮০ টাকা। কিন্তু আলুর বর্তমান বাজারদর মণ প্রতি ২শ’ ৪০ থেকে ২শ’ ৬০ টাকা। এ অবস্থায় প্রতি মণ আলুতে তাকে লোকসান গুণতে হচ্ছে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা। হিমাগার খরচ ধরলে খরচের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলেও জানান তিনি।

আরিফ আরও জানান, সরকার যদি আলুর বাজার মূল্য নির্ধারণ না করে দেয় এবং বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা না করে, তবে চলতি বছর প্রত্যেক আলু চাষিকে লোকসান গুণতে হবে। এতে অনেক কৃষকই আলু চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী এলাকার আলু চাষি দুলু মিয়া বলেন, আমরা এবার আলুর বাম্পার ফলন পেয়েও বিপদে পড়েছি। প্রতি ৯০ কেজি আলুতে উৎপাদন খরচ প্রায় ৬শ’ ৭৫ টাকা করে পড়লেও একই পরিমাণ আলু বিক্রি করতে হচ্ছে ৬শ’ থেকে ৬শ’ ২০ টাকায়। কোনও কোনও চাষি এই লোকসান মেনে নিয়ে আলু বিক্রি করতে চাইলেও তারা ক্রেতা পাচ্ছেন না।’
দুলু মিয়া আরও জানান, বিগত বছরগুলোতে হিমাগার থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছর ঋণ তো দূরের কথা, হিমাগার কর্তৃপক্ষ আলু কিনতেও অনিহা প্রকাশ করছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের আলু চাষি তৈয়ব আলী জানান, উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে চলতি মৌসুমে তিনি প্রায় ৮ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। গত বছরের চেয়ে এ বছর আলুর ফলন বেশি হয়েছে। তবে আলুর বাজারমূল্য কম হওয়ায় লোকসান গুণতে হচ্ছে তাকে।
এই কৃষক আরও বলেন, এখন সরকারই আমাদের একমাত্র ভরসা। সরকার আলুর বাজারমূল্য নির্ধারণ করে দিলে আমরা লোকসানের হাত থেকে বাঁচবে।’

১৬টি নদ-নদী বিধৌত কুড়িগ্রাম জেলার বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ অঞ্চলের মানুষের হাসি-কান্না মূলত রবিশস্যের ওপর নির্ভর করে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এ বছর জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিস্তৃর্ণ জমিতে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এসব ক্ষেত থেকে আলু তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। আলুর ফলন নিয়ে মনে স্বস্তি থাকলেও এর বাজারমূল্য নিয়ে মুখে হাসি নেই চাষিদের। এছাড়া, এবার বাইরের জেলাগুলো থেকে ব্যাপারিরা না আসায় ক্রেতা সংকটেও পড়েছেন চাষিরা।

চাষিদের কাছে আলু কিনে দেশের বিভিন্ন বাজারসহ রফতানিকারকদের কাছে আলু বিক্রি করেন ব্যাপারি সোলায়মান বাদশা। তিনি বলেন, এবার জেলাজুড়ে আলুর ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন বাজারে চাহিদা না থাকায় এবং রফতানি নিয়ে ঝামেলার কারণে কেউ আলু কিনতে চাচ্ছেন না। আমরা যদি বেচতে না পারি, তাহলে আলু কিনে বিপদে পড়বো। বিগত বছরগুলোতে হিমাগার মালিকেরা আলু কিনে এবং আলু চাষিদের লোন দিয়ে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছিল, তাই এবছর তারাও আলু কিনতে বা কৃষকদের লোন দিতে আগ্রহী নয়।’

আলুর কম দাম এবং চাষিদের লোকসানের কথা স্বীকার করে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক জাহেদুল হক চৌধুরী জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ৭ হাজার ২শ’ ৯১ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সামান্য কম। তবুও চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনকূলে থাকায় আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে আলুর বাজারমূল্য কম হওয়ায় এবং ক্রেতা সংকট দেখা দেয়ায় কৃষকেরা দুঃচিন্তায় পড়েছেন। এখন যদি সরকার আলু বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করে, তাহলে হয়তো কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন।