প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ফ্রান্সের ট্রাক হামলা
ডেস্ক: গত নভেম্বরে প্যারিস হামলার পর আবারও রক্তে রঞ্জিত ফ্রান্সের রাজপথ। এবারের হামলা দেশটির জাতীয় দিবস উদযাপনের সময়। বাস্তিল দিবস উপলক্ষে দেশটির নিস শহরের বিখ্যাত চত্বর প্রমেনেদে দেস অঁলেতে বৃহস্পতিবার রাতে আতশবাজি দেখতে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো মানুষ। আতশবাজির খেলা শেষ হতে না হতেই সেখানকার জমায়েতের ওপর দিয়ে একটি ট্রাক চলে গেলে তাতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৮৪ জন। মর্মান্তিক এই ঘটনায় আবারও শোকে ভাসছে ফ্রান্স। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বর্ণনায় উঠে এসেছে হামলার ভয়াবহতা। সিএনএন অবলম্বনে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের ভাষ্য তুলে ধরা হলো।
এক বন্ধুর বিয়েতে যোগ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস থেকে নিস শহরে এসেছিলেন ক্রিস্টেন ক্রাউচ। প্রমেনেদে চত্বরে হাজির ছিলেন তিনিও। আতশবাজি শেষ হওয়া মাত্রই ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘দুইটি শব্দ শুনেছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা আতশবাজিরই শব্দ। আর কিছু ভাবিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম যে সব মানুষ উলটো দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। তারা সবাই চিৎকার করছিল ফ্রেঞ্চ ভাষায়।’ক্রাউচ ও তার বন্ধু যতক্ষণে টের পেলেন যে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন, তারা কাছের একটি অ্যাপার্টমেন্টে আশ্রয় নেন। মানসিকভাবে ক্রাউচ তখন ভেঙে পড়েছেন। আগের সপ্তাহেই ডালাসে পাঁচ পুলিশ নিহতের ঘটনার সময় তিনি ছিলেন ডালাসে। নিস শহরের হামলার স্বাক্ষীও হলেন তিনি। ক্রাউচ বলেন, ‘এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে গত সপ্তাহে আপনাকে ফেসবুকে দুইবার নিরাপদ রয়েছেন বলে জানাতে হয়েছে। এমন একটি বিশ্বে নিশ্চয় আমরা বেঁচে থাকতে চাই না।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মিশরীয় নাগরিক নাদার এল শাফেয়ি জানান, তিনি ট্রাকচালককে ট্রাক থামানোর জন্য অনুরোধও করেছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে চিৎকার করে বলছিলাম থামার জন্য। তাকে হাত দিয়ে বারবার বুঝাচ্ছিলাম থামানোর জন্য। তাকে বলার চেষ্টা করছিলাম যে এরই মধ্যে তার ট্রাকের তলায় অনেকেই পিষ্ট হয়েছে। কিন্তু সে কোনোভাবেই ট্রাকের বাইরে নজর দিচ্ছিল না। এমন সময় তাকে মোবাইল ফোনের মতো কিছু একটা হাতে নিতে দেখলাম। ভেবেছিলাম সে হয়তো এই দুর্ঘটনার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দিবে। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। কারণ তার হাতের বস্তুটি ছিল পিস্তল। সেটা দিয়ে সে পুলিশকে গুলি করতে শুরু করে।’
প্রমেনেদে চত্বরের কাছেই একটি হোটেলের ব্যালকনি থেকে আতশবাজি দেখছিলেন ডমিনিক মলিনা ও তার স্বামী। তাদের ১৪ বছর বয়সী ছেলেও ছিল সঙ্গে। তিনি জানান, মুহূর্তের মধ্যেই ট্রাকটি অতর্কিতে ভিড়ের দিকে চলতে থাকে। ঘণ্টায় প্রায় ২৫ মাইল (৪০ কিলোমিটার) বেগে এটি পিষতে থাকে সামনে আসা মানুষদের।
মলিনা বলেন, ‘সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরি। আমার মনে হয়েছিল তাকে বাঁচাতে হবে এবং এমন একটি দৃশ্য তাকে দেখতে দেয়া যাবে না। সে কাঁপছিল। এমন দৃশ্য যেন কাউকে কখনও দেখতে না হয়।’ তিনি বলেন, ট্রাকটি যখন মানুষদের পিষতে পিষতে এগিয়ে যাচ্ছিল তার শব্দ তিনি হোটেলের ব্যালকনি থেকেই শুনতে পাচ্ছিলেন। এরপর শুনতে পান গুলির শব্দ। তখন পড়ে থাকা নিথর দেহগুলোর চারপাশে উন্মত্ত জনতা ছোটাছুটি করছিল।
তিনি বলেন, ‘গুলির শব্দের কয়েক মুহূর্ত পরেই চারপাশ শান্ত হয়ে পড়ে। আর তারপরই শুরু হয় হাহাকার, চিৎকার আর কান্নার রোল।’ মলিনার স্বামী টনি জানান, কমপক্ষে ১০টি মৃতদেহ তিনি ব্যালকনি থেকেই রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখতে পাচ্ছিলেন।
ফ্রান্সে ২৫ বছর ধরে বাস করছেন পল ডিলেন। তিনিও আতশবাজি দেখতে গিয়েছিলেন প্রমেনেদেতে। আতশবাজি শেষ হতেই দেখতে পান দলে দলে মানুষ ছুটে আসছে বিপরীত দিক থেকে। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গী তৎক্ষণাৎ আমার হাত ধরে এবং সবার সঙ্গে আমরাও ছুটতে থাকি। চারপাশে তখনও উচ্চস্বরে বাজছে গান। সত্যি বলতে, ধারণাই ছিল না যে কী ঘটেছে।’ হামলাকারী ট্রাককে দেখতে পাননি ডিলেন। তবে তিনি বলেন, ‘মানুষ ঊধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল, চিৎকার করছিল ও কান্না করছিল। যে যার মতো সন্তানদের কোলে-কাঁধে নিয়ে ছুটছিল। গোটা পরিবেশই ছিল অত্যন্ত ভয়ের। আমরা কেবল জানতাম, আমাদের প্রাণ নিয়ে বাঁচতে হবে। আর সেটা তখন করছিলাম।’
প্রমেনেদে হামলার পর অনেকেই আশেপাশের রেস্টুরেন্টগুলোতে ঠাঁয় নিয়েছিলেন। মারিয়াম ভায়োলেট নামের একজন বলেন, ‘আমরা তখন রেস্টুরেন্টে খাচ্ছিলাম। হঠাৎই দলে দলে মানুষ এতে ঢুকতে থাকে রেস্টুরেন্টে এবং আমরা তখনও বুঝতে পারিনি যে কী ঘটেছে। আমি এগিয়ে যাওয়ার পরে দেখলাম অনেক মানুষ তাদের তাদের পরিবার নিয়ে একাট্টা হয়ে রয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলাম অনেক মৃতদেহ, যেগুলোর আশেপাশে কেউই ছিল না।’ প্রমেনেদে থেকে পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম এরিক ডারটেল বলেন, ‘গোটা রাস্তায় ধ্বংসলীলার চিহ্ন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মৃতদেহ, ভাঙাচোরা সাইকেল, রাস্তার বাতি, জঞ্জাল।’
প্রমেনেদের পাশেই একটি বাড়ির বাসিন্দা জেনেপ আকার। বাড়ির ব্যালকনি থেকে দেখছিলেন আতশবাজি। আর তা দেখতে গিয়েই তিনি প্রত্যক্ষ করলেন নারকীয় তা-ব। আকার বলেন, ‘হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম ভাঙচুরের শব্দ, মানুষের চিৎকার। হাজার হাজার মানুষ ছিল সেখানে।’ গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে পড়েন আকার, নিভিয়ে দেন ঘরের বাতি। বাস্তিল দিবসের উদযাপনে যোগ দিতে নিসে এসেছিলেন জর্জিয়া টেক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ব্রেন্ডেন ফিলিপস।
তিনি বলেন, আতশবাজি শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই তার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে ধাবিত হতে দেখেন পুলিশের গাড়ি। তখন বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসতে দেখেন হাজার হাজার মানুষকে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা তখন সব মানুষদের দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছিল বলে জানান ফিলিপস। আমেরিকান একজন প্রত্যক্ষদর্শী প্রমেনেদেতে হামলাকারী ওই ট্রাক দেখতে পেয়েছিলেন। ওই ট্রাকটি একের পর এক মানুষকে পিষে ফেলছিল আর গতি বাড়াচ্ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুরুতে মনে হয়েছিল এটা ছিল দুর্ঘটনা। কিন্তু একটু পরই স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে ট্রাকটি ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজ করছে।