পবিত্র দ্বীন ইসলামে বাল্যবিবাহ

আল্লামা খাজা মুহম্মদ নূরউদ্দীন: আমাদের দেশে অমুসলিম বিশ্বের পরাশক্তিদের চাপিয়ে দেয়া কিছু আইন এখনো বলবৎ আছে। তার মধ্যে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অন্যতম। সরকার, প্রশাসন, এনজিও ও কিছু ধর্মব্যবসায়ীদের ইন্ধনে আমাদের দেশে  বাল্যবিবাহ বন্ধে জোর প্রচারণা ও প্রচেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে বাল্য বিবাহ নিয়ে বিরোধীতায় নামার আগে দেখা দরকার ছিলো পবিত্র দ্বীন ইসলামে বাল্যবিবাহ অনুমোদন বা নিষোজ্ঞা রয়েছে কিনা। শরীয়া আইন মোতাবেক বাল্যবিবাহের কী হুকুম রয়েছে।
এবার আসুন দেখা যাক বাল্য বিবাহ নিয়ে পবিত্র কুরআন ও পবিত্র হাদীছ পাকে কী বর্নিত আছে।
পবিত্র কুরআন শরীফ-এ সূরা নিসার ৩নং পবিত্র আয়াতে কালিমায় স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক নিজেই বাল্যবিবাহের বিষয়টি বান্দা-বান্দীকে জানিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ
অর্থ: “আর যদি তোমরা ভয় কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের হক্ব যথাথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভালো লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত।” (সূরা নিসা ৩নং আয়াত শরীফ)
উপরোক্ত আয়াত শরীফ-এ বর্ণিত يَتَامٰى (ইয়াতিম) শব্দ দ্বারা নাবালেগা বা অপ্রাপ্তবয়স্কা নারীকেই বুঝানো হয়েছে।
পবিত্র হাদীছ শরীফ-এ ইয়াতীমের বয়সসীমা সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে-
قَالَ حَضْرَتْ عَلِىُّ بْنُ أَبِى طَالِبٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ حَفِظْتُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُتْمَ بَعْدَ احْتِلَامٍ.
অর্থ : “হযরত আলী ইবনে আবী ত্বালিব আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার থেকে আমি হাদীছ শরীফ মুখস্থ করে রেখেছি যে, বালেগ হওয়ার পর ইয়াতীম থাকে না।” (আবু দাউদ শরীফ ২৮৭৫, সুনানে কুবরা বায়হাক্বী ৬/৫৭ হাদীছ ১১৬৪২, মুজামুল কবীর তাবরানী ৩৪২২, সুনানে ছগীর লি বায়হাকী ২০৪৯, শরহুস সুন্নহ ৯/২০০, ফতহুল বারী ২/৩৪৬, উমদাতুল ক্বারী ২১/১০৭, কানযুল উম্মল ৬০৪৬)
এছাড়াও ইয়াতীমকে বিবাহের বিষয়ে এবং বিবাহ বন্ধনে তার সম্মতির বিষয়ে একখানা ছহীহ হাদীছ শরীফ রয়েছে-
عَنْ حضرت أَبِي هُرَيْرَةَ عليه السلام قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ الْيَتِيمَةُ تُسْتَأْمَرُ فِي نَفْسِهَا فَإِنْ صَمَتَتْ فَهُوَ إِذْنُهَا وَإِنْ أَبَتْ فَلاَ جَوَازَ عَلَيْهَا ‏”‏ ‏.‏ قَالَ وَفِي الْبَابِ عَنْ أَبِي مُوسَى وَابْنِ عُمَرَ  ام المؤمنن وَعَائِشَةَ عليها السلام ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ حَدِيثٌ حَسَنٌ
অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইয়াতীম কুমারী থেকে তার বিবাহের ব্যাপারে সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। যদি সে চুপ থাকে তবে তাই তার সম্মতি বলে গণ্য হবে। আর যদি অস্বীকার করে তবে তার উপর তা কার্যকারী হবে না।
উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার সনদ উত্তম ও সকল রাবী ছেকাহ।
বাল্যবিবাহের পক্ষে আরো একটি পবিত্র আয়াত শরীফে মহান আল্লাহ পাক ইদ্দত বিষয়ে ইরশাদ করেন-
وَاللَّائِي يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيضِ مِن نِّسَائِكُمْ إِنِ ارْتَبْتُمْ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَاثَةُ أَشْهُرٍ وَاللَّائِي لَـمْ يَـحِضْنَ ۚ
অর্থ : “তোমাদের আহলিয়াদের মধ্যে যাদের মাজুরতার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনও মাজুরতার বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে।” (পবিত্র সূরা তালাক্ব শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ-এ মহান আল্লাহ পাক আরো স্পষ্টভাবেই বাল্যবিবাহের বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন। কেননা এ আয়াত শরীফ-এ মহান আল্লাহ পাক “যাদের মাজুরতার আশা নেই” ও “মাজুরতার বয়সেই যারা পৌঁছেনি” তাদের উভয়ের ইদ্দতকাল বর্ণনা করে দিয়ে বাল্যবিবাহ নিয়ে সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছেন।
উপরোক্ত বর্ণিত পবিত্র আয়াত শরীফে “ইয়াতীম” ও তার ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ এবং লুগাত থেকে যা বোঝা গেলো,
ইয়াতীম মেয়েদের বা মাজুরতার বয়সেই যারা পৌঁছেনি তাদের বিবাহ করা যাবে। আর মেয়েদের মধ্যে ইয়াতীম হচ্ছে সেই সব মেয়ে যারা এখেনো বালেগ হয়নি।
এই বিষয়ে হযরত আবূ মূসা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার, হযরত ইবনে উমার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু  এবং উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম থেকেও পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। ইমাম হযরত আবূ ঈসা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার থেকে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা হাসান। (ছহীহ আবু দাউদ ১৮২৫, তিরমিযি শরীফ ১১০৯)
বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে আরো একটি ছহীহ হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে,
‏‏ وَقَالَ أَحْمَدُ وَإِسْحَاقُ إِذَا بَلَغَتِ الْيَتِيمَةُ تِسْعَ سِنِينَ فَزُوِّجَتْ فَرَضِيَتْ فَالنِّكَاحُ جَائِزٌ وَلاَ خِيَارَ لَهَا إِذَا أَدْرَكَتْ ‏.‏ وَاحْتَجَّا بِحَدِيثِ ام المؤمين عَائِشَةَ علهاالسملام أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم بَنَى بِهَا وَهِيَ بِنْتُ تِسْعِ سِنِينَ
অর্থ: হযরত ইমাম আহমাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ও হযরত ইসহাক রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, যখন ইয়তীম কণ্যার বয়স নয় (৯) বৎসর হয় আর তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় এবং সে সম্মতি দান করে তবে এই বিয়ে জায়িয। সাবালিকা হওয়ার পর আর তার ইখতিয়ার থাকবে না। উনারা হযরত উম্মুল মু’মিনিন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার ঘটনাকে দলীল হিসাবে পেশ করেন যে, যখন উনার বয়স মুবারক নয় (৯) বৎসর হয়, তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুজরা শরীফ মুবারকে তাশরীফ গ্রহণ করেন।
হযরত উম্মুল মু’মিনিন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম বলেন,
وَقَدْ قَالَتْ حضرت ام المؤمين عَائِشَةُ عليها السلام إِذَا بَلَغَتِ الْجَارِيَةُ تِسْعَ سِنِينَ فَهِيَ امْرَأَةٌ
“মেয়েদের বয়স নয় (৯) বছর হলে সে মহিলা।” (তিরমিযী ১১০৯, সুনানু কুবরা বায়হাক্বী ১৪২৫, ফতহুল বারী ২/৭১২)
নয় (৯) বছর হলে যদি মহিলা হয়, তবে তাকে বিবাহ করাও শরীয়ত সম্মত। যা ছহীহ পবিত্র হাদীছ শরীফ থেকেই প্রমাণ হলো।
সুতরাং প্রমাণিত হলো ইয়াতীম মেয়েকে (যারা এখনো বালেগ হয়নি বা মাজুরতার বয়সেই যারা পৌঁছেনি) বিবাহ করা যাবে। আরো স্পষ্ট হলো বাল্য বিবাহ খাছ সুন্নত ।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, দ্বীন ইসলামে বিয়ের কোন নির্দিষ্ট বয়স বাঁধা নেই। যে কোন বয়সে যেমন বিয়ে করা যায় তদ্রুপ বাল্য বয়সেও বিয়ে করাও সুন্নত। তবে বাল্য বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়। বলাবাহুল্য, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন কতটুকু গ্রহণযোগ্য? একটি মুসলিম দেশে ইসলমী বিরোধী কিংবা শরীয়ত বিরোধী আইন থাকা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতিহারে ঘোষণা দিয়েছেন, কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশ হবেনা। সেখানে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী চলমান আইন বহাল থাকা কি গ্রহণযোগ্য?