সীমান্ত হত্যা: প্রতিশ্রুতি অনেক, বাস্তবতা ভিন্ন

ঢাকা: ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও সীমান্তে বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধ হয়নি। এমনকি সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেনি তারা। দুই দেশের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষার না করার এধরনের উদাহরণ খুব কম। ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কোথাও কোনও দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি প্রতিবেশির সঙ্গে সমস্যার সমাধান না করা যায়, তাহলে জাতিসংঘে যাওয়ার বিকল্প নেই।
২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিও করে। ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয় বার বার।

এরপরও চলছে সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক হত্যা। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা। এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশীকে। ২০১৫ সালে হত্যা করা হয় ৪২ জনকে, এবছর তাদের নির্যাতনে আহত হয়েছেন ৬৮ জন, ২০১৬ সালে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। আর ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএফ ১৮ জনকে হত্যা করে।

বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে মারা গেছে ৯৩৬ জন বাংলাদেশী। এর মধ্যে বিএসএফের হাতে ৭৬৭ জন ও ভারতীয়দের হাতে ১৬৯ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে।
বিজিবির তথ্য দেয়া তথ্য মতে, ২০০৯ সালে ৬৭ জন, ২০১০ সালে ৬০ জন, ২০১১ সালে ৩৯ জন, ২০১২ সালে ৩৪ জন, ২০১৩ সালে ২৮ জন, ২০১৪ সালে ৪০ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন এবং ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ জন নিহত হয়েছেন।

বাংলাদেশ-ভারত দুপক্ষই যেখানে সংশ্লিষ্ট, সেখানে কথাগুলো উত্থাপন করা জরুরি বলে মনে করেন ভারতের মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’-এর সচিব কিরিটি রায়। টেলিফোনে তিনি বলেন, বারবার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হচ্ছে। দুই দেশ পরস্পর যা বলছে, তা কার্যকর কেন হবে না, সে প্রশ্ন করা জরুরি। তারা তো বন্ধুরাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে থাকা আর কোনও সীমান্তে এধরনের পরিস্থিতি হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, নেপালে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার আছে, সেখানে তো এসব হচ্ছে না। বাংলাদেশ সীমান্তে হচ্ছে কেন?’

আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক, মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছে। দ্বিপাক্ষিক সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটি রাখেনি।’

তিনি বলেন, তারা (ভারত) বলেছিল, সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে না। কিন্তু আমরা দেখলাম, সেটি মুখের বুলি হলো। এখনও প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক নিহতের ঘটনা ঘটছে।’

বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় হত্যাকান্ড বন্ধ হচ্ছে না উল্লেখ করে নূর খান আরও বলেন, ফালানী হত্যা ঘটনার পরেও বিএসএফ দায়মুক্তির সুযোগ পেয়েছে। বিচার এমনভাবে হয়েছে যে, দায়মুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। একদিকে ফালানীর মামলা নষ্ট হয়েছে, আরেকদিকে রিটটিও সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। এধরনের হত্যা বন্ধের জন্য যে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার, তা নেয়া হচ্ছে না।’

ভারতের সঙ্গে নেপাল, চীন ও পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। ওইসব সীমান্তে মাসের পর মাস, দিনের পর দিন এধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে না উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কোথাও কোনও দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে অর্থাৎ জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি প্রতিবেশির সঙ্গে সমস্যা সমাধান না করা যায়, তাহলে আমাদের জাতিসংঘে যেতে হবে। এর বিকল্প কিছু দেখা যাচ্ছে না।’