আমেরিকার নার্সিং হোমে মৃত্যুপথযাত্রীদের ধর্ষিত হওয়ার করুণ কাহিনী

ডেস্ক: আমেরিকার প্রায় সহস্রাধিক নার্সিং হোমে অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী ও প্রতিবন্ধী বয়স্ক নারীরা সেবাসহকারীদের হাতে প্রতিনিয়ত সম্ভ্রমহরণের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি সিএনএনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন করুণ কাহিনী ওঠে এসেছে।
এসব নারীদের অনেকেই কথা বলতে পারে না। তারা তাদের শয্যা ত্যাগ ও প্রাকৃতিক কাজকর্মের জন্য ব্যক্তি ও হুইলচেয়ারের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন কারণেই তাদের স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। আরোগ্য লাভের জন্য তারা নার্সিং হোমে আসে।  কিন্তু এর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নাসিং হোমগুলোতে তারা শারীরিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

লুইস গোমেজ নিখুঁত নার্সিং সহকারী হিসেবে পরিচিত। তার যত্নে হোমের অধিবাসীরা তাদের বাড়ি চলে গিয়েছে। কিন্তু এই ব্যক্তিটিই এখন অন্য এক ইমেজে আবির্ভূত হয়েছে।
এই গোমেজের বিরুদ্ধে এখন ধারাবাহিকভাবে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে উঠেছে।

শারীরিক নির্যাতনের শিকার এক ভিকটিমের কন্যা বলেছে, ‘আপনার মা মারা গেছে- এমন ফোনকলের জন্য আপনি হয়ত প্রস্তুত কিন্তু ‘আপনার মা সম্ভ্রমহরণের শিকার হয়েছে’- এমনটি শুনার জন্য নিশ্চয় আপনি প্রস্তুত নন।’

দেশটিতে প্রায় ১ হাজার নাসিং হোমের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের এমন অকল্পনীয় ঘটনা ঘটছে। সেখানে অরক্ষিত সিনিয়াররাই সম্ভ্রমহরণের শিকার ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং সেটি হচ্ছে তাদের দেখাশুনা করার জন্য বেতনভূক্ত কর্মচারীদের হাতেই।

এটা জানা অসম্ভব ঠিক কত ভিকটিম এসব শারীরিক হয়রানির শিকার হচ্ছে। তবে, দেশটির রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় তথ্য এবং ভিকটিম পরিবারগুলোর সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ও নিয়ন্ত্রকদের সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা গেছে ইস্যুটি এতটা ব্যাপক যা যেকোনো ব্যক্তিরই কল্পনাকেও হার মানাবে।

এমনকি অনেক ক্ষেত্রে, এসব নার্সিং হোমের কর্তাব্যক্তিরা এবং সরকারি কর্মকর্তা এসব কিছু জেনেও না জানার ভান করছে কিংবা তা বন্ধে কোনো কিছুই করছে না।
এর পিছনে কখনো নির্ভেজাল এবং এমনকি ইচ্ছাকৃত অবহেলা কাজ করছে। এছাড়াও, যারা মনে বা স্বরণ করতে পারে না ঠিক কি ধরনের ঘটনা তাদের ওপর ঘটেছে কিংবা তাদের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়; সেসব ক্ষেত্রে নার্সিং হোমের অ্যাডমিনিস্ট্রেটররা এসব নারীদের রক্ষার প্রচেষ্টায় অক্ষম হচ্ছে। অনেক সময় নিজেরাই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে।

সিএনএনের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের পরিবারগুলো প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই ব্যর্থ হচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নার্সিং হোমের তদন্তে অযথা সময়ক্ষেপন করা হয় কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়।
এসব কারণে পুলিশ গোড়াতেই এসব ঘটনাকে অসম্ভাব্য হিসাবে মনে করে থাকে। ভিকটিমদের স্মৃতিশক্তি লোপ কিংবা কল্পনাপ্রসূত অভিযোগের দোহাই দিয়ে তা খারিজ করে দেয়।

পদ্ধতিগত এই ব্যর্থতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এমনকি অপরাধীরাও তাদের অপরাধের অভিযোগ থেকে সহজেই মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে।
এক কিশোরী কথা বলতে অক্ষম, রুখে দাঁড়াতে অক্ষম। সে আরো বেশি অরক্ষিত ছিলো যে, সে কিশোরী বয়সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্ভ্রমহরণের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিলো। বস্তুত, যখন সে সম্ভ্রমহরণের শিকার হয়েছিল তখন একজন শিশু হিসেবে সে অরক্ষিত ছিলো। মর্যাদা যা সে তার সারা জীবনে পেয়ে এসেছেন। কিন্তু এই বয়সে সম্ভ্রমহরণের শিকার ইতোমধ্যে তাকে কঠিন ‘আলঝাইমার্স’ রোগে ভোগাচ্ছে।’ মায়া ফিশার, তার মায়ের সম্ভ্রমহরণের শিকার হওয়ার কাহিনী ২০১৫ সালে আদালতে এভাবেই বর্ণনা করে।

একটি নার্সিং হোমের সহকারী তার মাকে সম্ভ্রমহরণ করায় আদালত ওই সম্ভ্রমহরককে দোষী সাব্যস্ত করে। চোখের পানি নিয়ে ফিসার তার মায়ের গল্প বিস্তারিত বর্ণনা করে।
সে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয় কিভাবে একজন কিশোরী মেয়ে হিসেবে তার মা সম্ভ্রমহরণ থেকে বাঁচতে তার পরিবারের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া থেকে পালিয়েছে ও জাপানি সৈন্যদের দ্বারা অল্পবয়সী মেয়েরা কিভাবে হত্যার শিকার হয়েছে। পরে নাসিং হোমে তাকে দেখাশোনা করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির দ্বারা কিভাবে সম্ভ্রমহরণের শিকার হয় তারও বর্ণনা দেয়।

একজন নারী নার্স জর্জ পিনগবাগ নামে তারই এক পুরুষ নার্সিং সহকারী ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে চারটায় মিনিয়াপলিসের ‘ওয়াকার মেথডিস্ট’ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৮৩ বছর বয়সী সনিয়া ফিশারের রুমে দেখতে পান। লোকটির কোমর থেকে পা পর্যন্ত কোন পোশাক ছিল না। তার মায়ের এডাল্ট ডায়াপার তার বিছানার উপর খোলা অবস্থায় ছিল। এ ঘটনা ওই সহকর্মী দেখে ফেলায় ৭৬ বছর বয়সী পিনগবাগ থতমত করতে থাকেন। সে জানায় যে, সে জানত সেখানে শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে।

মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অসহায় মানুষদের সঙ্গে তৃতীয় মাত্রার অপরাধমূলক শারীরিক আচরণের বিষয়টি প্রমাণ হওয়ায় জর্জ পিনগবাগকে ইতোমধ্যে আট বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

রায় দেয়ার সময় এক আবেগপূর্ণ বিবৃতিতে বিচারক পিনগবাগকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, সে (পিনগবাগ) ভিকটিম ও তার পরিবারের জীবনকে ধ্বংস করার চেয়েও খারাপ কিছু করেছে। অসুস্থ ও বয়স্ক এক নারীর সঙ্গে এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে একজন শুশ্রুষাকারী হিসেবে সে জনসাধারণের আস্থার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
বিচারক এলিজাবেথ কাটার শাস্তির শুনানিতে বলেছে, ‘তুমি কর্তৃত্বের সীমা ভঙ্গ করেছে। তুমি যা করেছ তার প্রভাব সুদূর প্রসারী। এটি নাসিং হোমে কর্মরত সকল শুশ্রুষাকারীকে আক্রান্ত করেছে। যারা ওই সেবার অধীনে আছে তাদেরকেও সমান আক্রান্ত করেছে। একই সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রিয়জনদেরকেও কষ্ট দিয়েছে।’
পিনগবাগ শুনানিতে দুঃখ প্রকাশ করে এবং কারাগারে বাইবেল নেয়ার পরিকল্পনার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তার আইনজীবী তার এই ইচ্ছাপূরণের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করে।

প্রসিকিউটর জানায়, পিনগবাগের এমন কর্ম এটাই প্রথমবার নয়। তার শারীরিক হয়রানির অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে ওই নাসিং হোমে এর আগেও একই কর্মের জন্য ‘ওয়াকার মেথডিস্ট’ কর্মকর্তারা তাকে তিনবার বরখাস্ত করে। এরমধ্যে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে সে প্রধান সন্দেহভাজন ছিলো।
২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে। একাধিক রোগে আক্রান্ত ৬৫ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে শারীরিকমিলনের অভিযোগ ওঠে। অন্যটি, ৮৩ বছর বয়সী অন্ধ ও বধির নারীকে শারীরিক নির্যাতন। ফিশারের মা জানায়, সে একাধিক বার সম্ভ্রমহরণের শিকার হয়েছে এবং প্রতিবারই মধ্যরাতে।
ফিশারের মা লাঞ্ছিত হওয়ার মাত্র সাত মাস আগে পুলিশ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত শুরু করে। অন্ধ হওয়ার কারণে যদিও ওই নারী তার নির্যাতনকারীকে চিহ্নিত করতে পারেনি। পরে ওই নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে সেবা দেয়ার জন্য রাতে দায়িত্বপালনরত পিনগবাগসহ অন্যান্য পুরুষ কর্মীদের সাসপেন্ড করা হয় এবং তদন্তে পিনগবাগের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে।

তবে, এসব অভিযোগের কোনটিই হোম কিংবা রাষ্ট্র দ্বারা প্রমাণ করা যায়নি। বছরের পর বছর ধরে ‘ওয়াকার মেথডিস্টে’ পিনগবাগ রাতের শিপ্টে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের এক ভোরে তার এই অপকর্ম অন্য এক নারী সহকর্মী দেখে ফেলায় তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়ছে।

যৌন নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের আরো কিছু অভিযোগ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে দায়ের করা হয়েছে। এসব অভিযোগ ওঠেছে সেখানে সেবাদানকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।

আইওয়াতে অপর একজন নারী জানায়, সে নিজে একাকি চলাফেরা ও গোছল করতে পারেন না। এজন্য তাকে অন্যের সহায়তা নিতে হয়। সে জানায়, একজন নার্সিং সহকারী গোছলের সময় তাকে শারীরিক নির্যাতন করে। পরে ওই সহায়তাকারী দেশ ত্যাগ করায় তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
৮৮ বছরবয়সী ক্যালিফোর্নিয়ার এক নারী যে তার সমগ্র জীবনে কেবল তার ৭০ বছর বয়সী স্বামীর কাছে শারীরিকমিলন করেছে। ওই নারী জানায়, নার্সিং হোমে তার মূত্রনিষ্কাশনযন্ত্র সরিয়ে ফেলায় সে হঠাৎ তার বিছানা থেকে জেগে উঠে এবং দেখে তার বিছানা ভিজা।

সে আরো একটি ঘটনার কথা স্বরণ করে জানায়, একজন অপরিচিতি পুরুষ নার্সিং সহকারী তার শরীর বিবস্ত্র করতে থাকে। সে কেন এমনটি করছে তা জিজ্ঞেস করলে বলেছে, এটি তার কাজের অংশ। এক সপ্তাহ পরে ওই নারী তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশে গুরুতর ব্যথা ও ‘ক্ষরণের’ কথা জানায়। শেষ পর্যন্ত তার দেহে দুরারোগ্য ‘হারপিস’ ধরা পড়েছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওই অপরাধীর পরিচয় নির্ধারণ করা যায়নি।
সিএনএনের বিশ্লেষনে এমন আরো কয়েকটি ঘটনা কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা সত্যিই পীড়াদায়ক।