উর্দুভাষীরা কি নাগরিকত্ব হারাচ্ছেন?

ঢাকা: দেশে প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই আইন বাস্তবায়ন হলে তারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন।

তারা বলেছেন, তাদের আগে আটকে পড়া পাকিস্তানি বলা হতো এবং হাইকোর্টের আশ্রয় নিয়ে তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। এখন প্রস্তাবিত আইনে নাগরিকত্বের ব্যাপারে নতুন কিছু শর্ত আরোপের পাশাপাশি আদালতের রায়ের ওপর আইনের প্রাধান্য দেয়ার কথাও বলা হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, কাউকে রাষ্ট্রহীন করা তাদের উদ্দেশ্য নয়।

ঢাকার মিরপুর এলাকায় উর্দুভাষীদের বসবাসের একটি ক্যাম্পে পরিচয় হয় স্নাতকের ছাত্র ইমরান খানের সাথে। ১৯৯১ সালে এই ক্যাম্পেই তার জন্ম। হাইকোর্টের রায়ের পর তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং অধিকারগুলো পেয়েছেন। কিন্তু প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তার মধ্যে ভয় ঢুকেছে।

তিনি বলছিলেন, “২০০৮ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর আমি জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছি। ভোটার হয়েছি এবং ভোট দিয়েছি। এখন অন্য বাংলাদেশিদের সাথে সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। নাগরিকত্ব হারালে এসব সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হতে পারি।”

মিরপুরের ক্যাম্পেই কথা হয় ৭০ এর বেশি বয়সের রাইসা খাতুনের সাথে। তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি বা ভোটার করা হয়নি। এতে তার আপসোস নেই। কারণ তার দুই ছেলে এবং এক মেয়ে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে বা ভোটার হয়েছে।

এখন এই অধিকার হুমকির মুখে পড়েছে প্রস্তাবিত আইনে। এমন আলোচনা তার মাঝেও উদ্বেগ ছড়িয়েছে।

বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের একজন নেতা সাদাকাত আলী খান। তারা প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন।

ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর এলাকায় ক্যাম্পে এবং দেশের উত্তরে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরসহ ১৩টি জেলায় সাড়ে চার লাখের মতো উর্দুভাষী বসবাস করছেন। তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সুবিধা বা অধিকারগুলো পাচ্ছেন হাইকোর্টের রায়ের পর।

উর্দুভাষীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী একটি সংগঠনের নেতা সাদাকাত আলী খানের বক্তব্য হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইন বাস্তবায়ন হলে তাদের জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই ভয় তাদের তাড়া করছে।

“আমরা ২০০৭ সালে রিট করেছিলাম। হাইকোর্ট পরের বছর রায় দেয়। তাতে বলা হয়েছিল, এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণকারী উর্দুভাষী সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক। আমাদের ভোটার করার কথাও বলা হয়েছিল। এই রায় অনুযায়ী উর্দুভাষীদের শতকরা ৯৮ ভাগই নাগরিকত্ব পেয়ে অধিকারগুলো ভোগ করছে। এখন প্রস্তাবিত আইনে আদালতের রায়ও প্রযোজ্য হবে না বলা হচ্ছে। সেটা হলে আমাদের নাগরিকত্ব বিপন্ন হবে।”

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, জন্মসূত্রে যিনি নাগরিক হবেন, তার পিতা মাতাকেও এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করতে হবে। পিতা মাতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে অথবা বাংলাদেশের শত্রু, এমন দেশের প্রতি আনুগত্য দেখালে, তাদের সন্তানরা নাগরিকত্ব পাবে না।

এসব শর্তের পাশাপাশি আদালতের রায়ের ওপর আইনের প্রাধান্য দেয়ার প্রস্তাবকে বড় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

উদ্বেগের বিষয়গুলোতে নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী কয়েকটি সংগঠন একটি ফোরাম গঠন করে আন্দোলন শুরু করেছে। এই আন্দোলনের অন্যতম একজন অধ্যাপক সি আর আবরার। তার নেতৃত্বাধীন সংগঠন রামরু শরণার্থী এবং অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে।

তিনি মনে করেন, প্রস্তাবিত আইনে যা বলা হয়েছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়ন হলে এর অপপ্রয়োগের শিকার বেশি হবে উর্দুভাষীরা।

“খসড়া আইনে কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন বিদেশি শত্রু, বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করা অথবা বাংলাদেশের বিরোধিতা করা, এ সবের ব্যাখ্যা করা হয়নি। ফলে আইনের অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকবে।”

আইনের খসড়ার বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে উদ্বেগ বা আপত্তির মুখে যদিও সরকার বলেছে, উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে খসড়ায় সংশোধন করার পরই প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। কিছু বিষয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আপত্তি বিবেচনা করা হয়েছে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

কিন্তু উর্দুভাষীদের উদ্বেগের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিবেচনার কোনো ইঙ্গিত এখনো দেয়া হয়নি।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, উর্দুভাষীরা আগে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব চেয়েছিল। সে কারণেই তাদের পরের প্রজন্মের ব্যাপারে কিছু শর্তের প্রস্তাব এসেছে।

“বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যারা থাকতে চায়, তাদের বাধাগ্রস্ত করার কোনো অভিপ্রায় আমাদের নেই। এটাই প্রস্তাবিত আইনের মূল থিম। কিন্তু যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে, সে সব ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব দেয়ার দায়বদ্ধতা নেই।”

আইনমন্ত্রী আরো বলেছেন, “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর উর্দুভাষীদের বড় অংশ পাকিস্তানের নাগরিকত্ব চেয়েছিল। তারা পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার জন্য অপশনও দিয়েছিল। তবে এখন তারা যা বলছেন, কী পরিস্থিতিতে এটা বলছেন, এসব খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তাদের বিষয়গুলো আলাদাভাবে দেখা হবে।”

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সাল থেকে উর্দুভাষীরা ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত তাদের শরণার্থী হিসেবে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হতো। তারা আটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের একটা অংশ পাকিস্তানে চলে যেতে চেয়েছিল।

তাদের নেতা সাদাকাত আলী খান মনে করেন, তাদের আগের প্রজন্মের একটা অংশের কর্মকাণ্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।

“আমাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তানে চলে যেতে চেয়েছিলেন। এতে আমাদের নাগরিকত্ব যায় না। যতক্ষণ না আমি পাকিস্তানে চলে যাই, ততক্ষণ আমার নাগরিকত্ব থাকবে। হাইকোর্টের রায়েই এটা বলা আছে। এখানেই আমাদের ভয় হয় যে, প্রস্তাবিত আইন বাস্তবায়ন হলে এক শ্রেণির লোক আমাদের বিরুদ্ধে এর অপব্যবহার করতে পারে।”

প্রস্তাবিত আইনের বিতর্কিত বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে অনেক আইনজীবীও সোচ্চার হয়েছেন।

তাদের মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী শাহদ্বীন মালিক বলেছেন, “পিতা-মাতার জন্য সন্তান নাগরিকত্ব পাবে না। এমন প্রস্তাব আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক হয়।”

“তাদের পূর্বপুরুষদের আটকে পড়া পাকিস্তানি বলা হতো। কিন্তু এখানে জন্মগ্রহণকারীরা তো বাংলাদেশি।”

হাইকোর্টের রায়ে যখন উর্দুভাষীদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে মীমাংসা হয়ে গেছে। সরকারও এর বিরুদ্ধে আপিল করেনি। এমন প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত আইনের শর্তগুলো পুরনো ইস্যুকে আবার আলোচনায় এনেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক সি আর আবরার।

আদালতে রায়ের ওপর আইনকে প্রাধান্য দেয়ার যে প্রস্তাব খসড়ায় এসেছে। তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের মধ্যেও আলোচনা রয়েছে। যদিও খসড়ায় প্রস্তাবিত শর্তের ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উর্দুভাষীদের একটা অংশের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পুরনো ইচ্ছার কথা তুলে ধরছেন।

একই সাথে তিনি বলেছেন, সরকার কাউকে রাষ্ট্রহীন করতে চায় না। সেজন্যই বিষয়গুলো নিয়ে তারা আরো আলোচনা পর্যালোচনা করছেন।

“রায়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। নাগরিকত্ব আইনে কিন্তু কারো উত্তরাধিকার বন্ধ করে না। এ ছাড়া তারা এখন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত আগে নেয়ার কোনো সুযোগ ছিল কিনা। এগুলো আমরা বিবেচনা করছি।”

নাগরিকত্বের ব্যাপারে দু’টি পুরনো আইন রয়েছে। এর একটি ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইন। অন্যটি হচ্ছে, ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার। সেগুলো বিলুপ্ত করে সরকারের নতুন আইন করার এই উদ্যোগের খসড়াটি মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।

এই পর্যায়েই কিছু বিষয়ে বিভিন্ন ফোরাম থেকে আপত্তি আসছে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিতর্ক হচ্ছে।

শাহদ্বীন মালিক মনে করেন, খসড়ায় আনা প্রস্তাবগুলো এভাবেই যদি রাখা হয়, তাহলে উর্দুভাষীদের জন্য সংকট বাড়বে।

অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এখন উদ্বেগ বা আপত্তির বিষয়গুলো পর্যালোচনা বা বিবেচনা করার ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। উর্দুভাষীরাও আশা করছেন, শেষপর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রহীন করা হবে না। -বিবিসি।