পবিত্র কোরআনের আয়াতের বানান বিকৃতি ও ভুলেভরা ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বই!

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ঢাকা: জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত মাধ্যমিক শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইতে অংসখ্যবার পবিত্র আয়াত ও পবিত্র হাদিস সহ বিভিন্ন স্থানে আরবী বানানের বিকৃতি ও ভুল প্রকাশিত হয়েছে। ভুলগুলোর ছবিসহ অনলাইনে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটিতে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ থেকে শুরু করে যে কয়টি আরবী পবিত্র সূরা, পবিত্র হাদিস, দোয়া আছে প্রায় সবকটিতে আরবী বানানে ভুল। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ২০১৪ সালের সংস্করণে বইটিতে কোনো ভুল পাওয়া যায় না; কিন্তু ২০১৬ সালের সংস্করণে এতোগুলো ভুল কিভাবে ঢুকলো। এ প্রশ্নে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে উত্তেজনা বিরাজ করছে গণমানুষের মধ্যে। অনেকেই এটাকে উদ্দেশ্যমূলক বা ইচ্ছাকরেই ভুল প্রবেশ করানো হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন। আবার কারো কারো অভিযোগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ও এনসিটিবিতে ব্যাপক সাম্প্রদাকি হিন্দু ও নাস্তিক নিয়োগের ফলে এরূপ সম্ভব হয়েছে।

বইয়ে ভুলের অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করেছেন মিরপুর ৬ নম্বরে অবস্থিত মাদরাসায়ে দারুল উলুমের মুহাদ্দিস, হাফেজ মুফতী মাসুম বিল্লাহ।

ভুলগুলো সম্পর্কে তার মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় কিতাবগুলোকে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেয়া হয় না। গুরুত্ব না দেয়ার কারণে এসব দায়িত্বহীনতা। অথবা অযোগ্য লোক দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। আর যারা বইটি ক্লাসে পড়াচ্ছেন তাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ।’

এনসিটিবি’র নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছে, ‘আমি তো নতুন এসেছি, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি। আপনি যদি একবার কারেকশন কপিটি দিয়ে যান, পরবর্তীতে ছাপার সময় আমরা সঠিকভাবে ছাপাতে পারবো।’

ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে আরবী বানানে ৫৮টি ভুলের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি’র প্রধান সম্পাদক প্রীতিশকুমার সরকার দাবি করেছে, ‘এতদিন ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে আরবীতে লেখা পবিত্র কুরআন ও পবিত্র হাদিস-এর অংশবিশেষ পুনঃপাঠ বা বানান পরীক্ষণের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) অভিজ্ঞ কোনো লোকবল ছিল না। রচয়িতা, সম্পাদক, জাতীয় কারিকুলাম কো-অর্ডিনেটর কমিটি (এনসিসিসি), ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত, অভিভাবকদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুনঃসংযোজন বা বিয়োজন করা হতো।’

বই রচনা প্রসঙ্গে সে বলেছে, ‘যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের সে বিষয়ের পাঠ্যবই রচনা এবং সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয়। লেখক যখন একটি বই সম্পন্ন করেন, তখন সেটি সম্পাদকের সম্পাদনা শেষে এনসিসিসি কমিটিতে পাঠানো হয়। এনসিসিসিতে শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গড়া ২২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে।’

‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটির রচয়িতা হলেন- মুহাম্মদ আবদুল মালেক, ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ, ড. মোহাম্মদ ইউছুফ, মুহাম্মদ ইউসুফ আলী শেখ, ইকবাল জাহাঙ্গীর আলম ।

বইটি সম্পাদনা করেছে, ডক্টর আখতারুজ্জামান ও মুহাম্মদ তমীযুদ্দীন। এনসিসিসি’র কার্যক্রম সম্পর্কে প্রীতিশকুমার বলেছে, ‘জাতীয় কারিকুলাম কো-অর্ডিনেটর কমিটি বইটিকে ধর্ম-রাষ্ট্র-ব্যক্তি-পক্ষপাতদুষ্ট কোনো কিছু আছে কি না তা নির্ণয় করে। অসংলগ্ন কিছু পেলে সেটিকে অধিকতর নিরীক্ষার জন্য স্পেশাল কমিটি গঠন করে। স্পেশাল কমিটির রিপোর্ট, লেখক, সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে এনসিসিসি বিষয়টি বিয়োজন বা সংযোজন করে থাকে। তারপর বইটির বিষয়বস্তুগুলো এনসিটিবিতে পাঠানো হয়।’

এতগুলো হাত ঘুরে যে বইটি তৈরি হয়, সে বইটিতে এত ভুল, যারা বইটি পড়াচ্ছে তারাও ধরতে পারেনি, এ বিষয়ে এনসিটিবি’র কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলেছে, ‘ভুলের জন্য আমরা লজ্জিত। যারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয় তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তবে দুঃখের বিষয়- কোনো শিক্ষক আজ অবধি এ বইটিতে ভুল আছে এরকম কোনো অভিযোগ বা তথ্য আমাদেরকে দেননি। শিক্ষক এবং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সে বলেছে, ‘এটার উত্তর দেয়া দুষ্কর।’ দুই বছর ধরে ভুলে ভরা বইটি শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে, এনসিটিবি প্রতি বছর বইটির পরিমার্জন বা পুনর্মুদ্রণ করছে। পরিমার্জনের ফলাফল কী হলো?

প্রীতিশকুমার বলেছে, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে সম্মানি দিয়ে রাখা হয়।’ জানা যায়, এ বইটির দায়িত্বে ছিলেন এনসিটিবি’র সদস্য (কারিকুলাম) প্রফেসর মশিউজ্জামান। আরবী বানান তদারকির জন্য ৬ মাস আগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে উম্মে কুলসুম নামে একজনকে।

গুরুত্বহীনতার কারণে এরকমটা ঘটছে কিনা? এ প্রশ্ন করা হলে মশিউজ্জামান বলেন, ‘বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ লোকবল দিয়ে বই প্রণয়ন, সম্পাদন, সুপারভিশন করা হয়। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।’ তাহলে ভুলের দায় কে নেবে? মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা তো দায় এড়াতে চাচ্ছি না। আর আপনি যে ভুলের কথা বলছেন আমি তো জানি না এগুলো কতটা ভুল। অভিযোগ পেয়েছি, এখন যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদেরকে দিয়ে এ বিষয়ে কয়টা ভুল আছে তা নিশ্চিত করতে হবে।’

যে প্রক্রিয়ার কথা আপনি বলছেন সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গত চার বছর বইটি প্রক্রিয়াজাত হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে। বইটি পরিমার্জিত, পুনর্মুদ্রণ সংস্করণ সবমিলিয়ে বিশেষজ্ঞদের হাত ঘুরে বেরিয়েছে। ভুল তো সংশোধন হয়নি। এখন কীভাবে হবে? উত্তরে মশিউজ্জামান বলেন, ‘আর কী প্রক্রিয়া আছে বলেন। বই প্রণয়নের এটাই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়। তাহলে ভুল কেন? এর উত্তর তিনি দিতে পারেননি।

উম্মে কুলসুমের কাছে একই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি সপ্তম শ্রেণীর বইটি দেখি। এ বইটি রেবেকা সুলতানা লিপি দেখেন।’ সেসময় রেবেকা সুলতানা লিপিকে পাওয়া যায়নি। লিপি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করছেন।

২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইতে এযাবৎ সনাক্ত করা কিছু ভুল উল্লেখ করা হলো-

(১) পৃষ্ঠা ৪-৫: পবিত্র কালেমা শাহাদাত লিখতে বানানে ১০টি ভুল।

(২) পৃষ্ঠা-১১, ২১, ২২, ২৮, ৩১: আরবী শিরোনামে ৭টি ভুল।

(৩) পৃষ্ঠা-২৭: পবিত্র সূরা বাকারা উনার ৪৩নং পবিত্র আয়াতে ১টি বানান ভুল।

(৪) পৃষ্ঠা-২৮: পবিত্র সূরা আন নিসা উনার ১০৩নং পবিত্র আয়াত লিখতে ৫টি ভুল।

(৫) পৃষ্ঠা-৩৮: পবিত্র সূরা আন নিসা উনার ১০৩নং পবিত্র আয়াত লিখতে আবারো ৫টি ভুল।

(৬) পৃষ্ঠা-৪৭: সূরা আল-মুযযাম্মিলের ৪নং পবিত্র আয়াত লিখতে ১টি ভুল।

(৭) পৃষ্ঠা-৫৭: পবিত্র সূরা ফাতিহা লিখতে ১টি ভুল।

(৮) পৃষ্ঠা-৫৯: পবিত্র সূরা আন নাস লিখতে ২টি ভুল।

(৯) পৃষ্ঠা-৫৭, ৫৯, ৬২, ৬৬: পবিত্র বিসমিল্লাহ লিখতে ৪বার ভুল।

(১০) পৃষ্ঠা-৬৪: পবিত্র সূরা হুমাযাহ লিখতে ৪টি ভুল।

(১১) পৃষ্ঠা-৭১: দুটি পবিত্র হাদিস লিখতে ২ জায়গায় বানান ভুল।

(১২) পৃষ্ঠা-৮১: পবিত্র সূরা বনী ইসরাইল লিখতে ১টি ভুল।

(১৩) পৃষ্ঠা-৮২: পবিত্র সূরা বাকারাহ উনার ২১৫নং পবিত্র আয়াত লিখতে ১টি ভুল।

(১৪) পৃষ্ঠা-৮২: পবিত্র হাদিস লিখতে ১টি ভুল।

(১৫) পৃষ্ঠা-৮৩: পবিত্র সূরা আন নহল উনার ৯০নং পবিত্র আয়াত লিখতে ২টি ভুল।

(১৬) পৃষ্ঠা-৮৫: একটি পবিত্র হাদিস লিখতে ৭টি ভুল।

(১৭) পৃষ্ঠা-৮৮: পবিত্র সূরা বাকারাহ উনার ৪২নং পবিত্র আয়াত লিখতে ১ ভুল।

(১৮) পৃষ্ঠা-৯১: পবিত্র হাদিস লিখতে ১ ভুল।

(১৯) পৃষ্ঠা-৯২: পবিত্র সূরা বনী ইসরাইল-এর ২৭নং পবিত্র আয়াত লিখতে ২টি ভুল।

এভাবে এপর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইতে মোট ৫৮টি ভুল উপস্থাপনা পাওয়া গেছে।

ভুলগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিক্রিয়ায় একজন বলেন- এগুলো সাধারণ কোনো ভুল নয়, পবিত্র কুরআন-হাদিস বিকৃতভাবে উপস্থাপন।

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অনেকে শিক্ষামন্ত্রীকে এবং ভুলের সাথে সকল সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করার এবং বইটির লেখকদের ও সম্পাদকদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। একইসাথে যতদ্রুত সম্ভব বইয়ের সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে সকল স্কুল ও বাজার থেকে তুলে নেয়ার দাবি উঠেছে।