মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতে পারায় গর্বিত বাকের আলী

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ডেস্ক:: একাত্তরের ১৭ এপ্রিল পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। আর সেই অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেছিলেন ১৭ বছরের এক কিশোর বাকের আলী। যিনি কয়েক বছর আগে কলেজ শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। সেদিন কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে তিনি এই দায়িত্বটি পালন করেছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন সাংবাদিকদের।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত কন্ঠে বাকের আলী বলেন, ১৯৭১ সালে তিনি দর্শনা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিহারী অধ্যুষিত দর্শনায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। সুযোগ বুঝে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ১৬ এপ্রিল বিকেলে বর্তমান মুজিবনগর উপজেলার গৌরীনগর গ্রামের নিজ বাড়িতে চলে আসেন।

তিনি বলেন, ‘ওই দিন রাতে শুনলাম ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথ তলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। কিসের সভা, কি উদ্দেশ্যে হবে সবকিছুই রয়ে গেল অজানা। সকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পায়ে হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার স্কুল শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন স্যার সেখানে ছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, আমাকে এ অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে বাকের আলীর শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন বলেন, ‘বাকের স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুললিত কন্ঠে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতো। এছাড়াও সে ছিল ধর্মভীরু। তাই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তাকেই টেনে নিয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, সেই সময় তিনি দরিয়াপুর মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের পর ভবেরনগর, সোনাপুর, মানিকতলা, মাঝপাড়াসহ পাঁচটি গ্রাম নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। তিনি ছিলেন সেই সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। আর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায় ছিল এই সংগ্রাম কমিটি।

বাকের আলী সেদিনের অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে বলেন, প্রথমে ভয় পেলেও স্যারের হাত ধরে মঞ্চের কাছে গিয়ে দেখেন সেখানে বসে আছেন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ক্যাপটেন এম. মনসুর আলী এবং কর্নেল এম.এ.জি ওসমানিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী একটি কাগজে বাকেরের নাম লিখে বললেন, ‘বাবা তোমাকে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। তুমি আমাদের সাথেই মঞ্চে উঠবে।’ একটু পরেই মাইকে ঘোষণা করা হয় বাকের আলীর পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শুরু হবে আজকের এই ঐতিহাসিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান।

সেই সময়ের অনুভূতি ব্যক্ত করে বাকের বলেন, আমি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করছি, দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিল।

সেদিন এই ভূমিকা রাখতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন বাকের আলী। তিনি বলেন, প্রাণের টানে তিনি সেদিন মুজিবনগরে ছুটে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি জানান- মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে মুজিবনগরে যত অনুষ্ঠান হয়েছে তিনিই পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেছেন।

মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার পর ২০১৩ সালে বাকের অবসরে যান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ করেন। তার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে মোহাম্মদ আল মুরাদ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পিতা বাকের আলী পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের সুযোগ পাওয়ায় পুত্র মোহাম্মদ আল মুরাদও গর্বিত। তবে দুঃখ করে বলেন, পিতার ইচ্ছে ছিল মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া, সেটা তিনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে বুঝি আর পারবেন না। বাকের আলীও এত দিনে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা না পাওয়ায় তার মনোবেদনার কথা বলেন।