রেলওয়েতে ১৪ হাজার পদ খালি

রেলওয়েতে ১৪ হাজার পদ খালি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রেলওয়ে ভয়াবহ জনবল সংকটে রয়েছে। রেলওয়ের ১৪ হাজার পদ খালি পড়ে আছে যা তাদের দরকারি লোকবলের ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে ১৩ হাজারই কারিগরি পদ যাদের দরকার হয় ট্রেন চালানো, লাইন দেখাশোনা বা সিগনালের কাজে। লোকবলের অভাবে প্রায় ৭০টি ট্রেন স্টেশন বন্ধ হয়ে রয়েছে। অন্যদিকে পুরনো দক্ষ কর্মীরা চলে যাচ্ছেন অবসরে।

মাহবুব হাসান নামের এক যাত্রী বলছেন, গত ২২ তারিখে আমার একটা চাকরির ইন্টার্ভিউ ছিল। সেটার জন্য ট্রেনে ঢাকা আসছিলাম। সাড়ে দশটার সময় জয়দেবপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার কথা কিন্তু প্রায় ১২টা বেজে গেছে তখনো ট্রেন ছাড়েনি। খবর নিয়ে জানা গেলো টঙ্গিতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই দেরি হচ্ছে। এরকম ঘটনাতো নিয়মিত ব্যাপার।

তিনি বলছেন, প্রায়ই দেখা যায় যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রেল সময় মতো ছাড়তে পারে না। এইসব ত্রুটি সারার জন্য যে সমস্ত কারিগর প্রয়োজন তা যথেষ্ট না থাকায় দেখা যায় যে দেরি হচ্ছে। আর আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। ঠিক এমনটাই ঘটেছে কাছেই প্ল্যাটফর্ম তিন-এ দাঁড়িয়ে থাকা একটি আন্তঃনগর ট্রেনের ক্ষেত্রে। যাত্রা শুরুর অপেক্ষায় একজন মোহাম্মদ আজাদ। তিনি বলছেন, ট্রেনটা ছাড়ার কথা ছিল ২টা ৪০ এ। এখন সাড়ে তিনটা বাজে। কিন্তু এখনো যাচ্ছে না। লেট হচ্ছে। লেটের কারণ কি জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, আসতেই তো লেট করেছে।

শুধুমাত্র দেরিতে যাত্রা নয় প্ল্যাটফর্মের চেহারা, রেলের বগিগুলোর বাইরে ও ভেতরে, এমনকি রেলের কর্মীদের পোশাকেও ফুটে ওঠে সংস্থাটির দুর্দশা।

আর এর অন্যতম প্রধান কারণ বলা হচ্ছে, এর চাকা সচল রাখার জন্য যে পরিমাণ কারিগরি কর্মী দরকার তা নেই। রেলওয়ে বলছে, সঠিকভাবে যাত্রা পরিচালনায় দেশজুড়ে রেলওয়ের ৪০ হাজার লোক দরকার। কিন্তু এর এক তৃতীয়াংশই খালি পড়ে আছে।
সংস্থাটির অপারেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিয়া জাহান বলছেন, নতুন ট্রেন চালু করতে ড্রাইভার দরকার, সেখানে লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। স্টেশনে মাস্টার দরকার, পয়েন্টসম্যান দরকার। সেগুলো না থাকার কারণে ৬০/৭০টা ষ্টেশন বন্ধ আছে। স্টেশন বন্ধ থাকায় ট্রেন পরিচালনায় যেমন সমস্যা তেমনি দুইটা ট্রেনের ক্রসিং-এও সময় বেশি লাগছে। তাই সময়মতো ট্রেন পরিচালনার যে সমস্যা সেটা কাটাতে পারছি না। আর এসব সমস্যার প্রভাব পড়ছে যাত্রীদের উপরেই বেশি।

রেলওয়ের হিসেব মতে ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ২৯বার। সিগনাল ভুল হয়েছে ৯৬বার। এছাড়াও বগি আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা বা রেল ক্রসিং এ দুর্ঘটনাও রয়েছে বহু। এই সময়কালে এসব দুর্ঘটনায় ২৭৭ জন যাত্রী মারা গেছেন। লেভেল ক্রসিং-এ মৃত্যুর সংখ্যা অবশ্য আরো অনেক বেশি।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহউদ্দিন আফ্রিকার বেশ কটি দেশে গণপরিবহন প্রকল্পে কাজ করেছেন। তিনি বলছেন, সড়কের উপরে বেশি মনযোগ দেয়ার কারণেই রেলের মতো একটি বহু যাত্রী বহনকারী গণপরিবহনকে অবহেলা করা হয়েছে। আর তাই রেল বহু সমস্যায় সমস্যায় জর্জরিত রয়ে গেছে।

তিনি বলছেন, রেল বিশ্বের একটা পুরনো গণপরিবহন ব্যবস্থা। বিশ্বের সকল দেশে রেলকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কিন্তু রেল লাইন বন্ধ করে অন্য যাতায়াত ব্যবস্থা চালু করেছে সেই নজির বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। আমরা সড়কের উপরে গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাস্তা বানিয়ে পুরো দেশটাকে মাকড়শার জালের মতো খ- বিখন্ড করে ফেলেছি। তিনি বলেন, সড়ককে গুরুত্ব দেয়ার কারণ হল সড়ক তৈরির সাথে জড়িত রয়েছে স্থানীয় রাজনীতি। এছাড়াও সেটি বানানোর ক্ষেত্রে যে অর্থ ব্যবহার হয় তাতে দুর্নীতিরও সুযোগ থাকে।

তিনি বলছেন, রেল একটি যাত্রীবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা। এটি পরিবেশবান্ধব। এতে করে অনেক বেশি মানুষ একসাথে পরিবহন করা যায়। একটা ট্রেন যতো যাত্রী বহন করে সেটা বাসে করতে গেলে যানজট তৈরি হয়। রেলে যানজট নেই। অনেক রাস্তা লাগে না। সোজা একটা রেল হলেই চলে। আর রেল প্রচুর কর্মসংস্থানও করতে পারে।