সীমান্ত দিয়ে যাচ্ছে ওষুধ আসছে মাদক, সক্রিয় ১০ সিন্ডিকেট

নিউজ নাইন২৪ডটকম, রাজশাহী: রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে এখন শুধু টাকার বিনিময়ে ভারত থেকে মাদকদ্রব্য আসছে না, মাদক আসছে ওষুধের বিনিময়েও। সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে বিশ্বমানের বাংলাদেশী ওষুধ। আর আনা হচ্ছে হেরোইন ও ফেন্সিডিলসহ জীবনঘাতি মাদক।

খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এ বিষয়ে বিস্তর তথ্য পেয়েছে।

তারা বলছেন, বিভিন্ন সময় চোরাই সরকারি ওষুধ আটকের পর গ্রেফতারকৃতদের কাছে ওষুধ বিক্রির স্থান জানতে চাইলে তারা জানাচ্ছে বাংলাদেশী ওষুধ সীমান্ত অতিক্রম করে পাঠানো হচ্ছে ভারতে। আর ভারতে রয়েছে বাংলাদেশী সরকারি ওষুধ ও জন্মনিরোধক বড়ির ব্যাপক চাহিদা।

এদিকে র‌্যাব-৫, রাজশাহীর সদস্যরা গত জুমুয়াবার ভোরে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে অভিযান চালিয়ে সরকারি ওষুধসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নাম রাশিকুল ইসলাম (২২)। উপজেলার বিদিরপুর মাদরাসা মোড় এলাকা থেকে ওষুধসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। রাশিকুল পার্শ্ববর্তী পিরিজপুর গ্রামের বাগানপাড়া এলাকার সাকিম উদ্দিনের ছেলে।

র‌্যাব-৫, রাজশাহীর রেলওয়ে কলোনি ক্যাম্পের স্কোয়াডন লিডার কেবিএম মোবাশ্বের রহিম জানান, রাশিকুলের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ওষুধগুলো হল এমোক্সিসিলিন সিরাপ ১০৭ বোতল এবং প্রায়োসিন ২০ বোতল।

তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি দীর্ঘদিন থেকে সরকারি ওষুধ চুরির বিষয়টি স্বীকার করেছে। ওষুধের বোতলের লেভেলে ‘বিক্রয় দন্ডনীয় অপরাধ’ লেখাটি ঘষে উঠিয়ে ফেলে হয়েছে। বড় ধরনের ওষুধের চালান তারা সীমান্তের ওপারে পাচার করে। এরপর ওষুধের বিনিময়ে ফেন্সিডিল বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য দেশে আনা হয়।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, গত ৮ মার্চ বিপুল পরিমাণ সরকারি ওষুধসহ একই উপজেলার বিদিরপুরহাট এলাকার বদরুল আলমের ছেলে কাওসার হোসেন ওরফে টিটু (২৭) নামে এক পাচারকারীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় সিপ্রেফেলাক্সসিন সাসপেনসন, এমোক্সাসিলিন এবং ওমিপ্রাজল গ্রুপের এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৫২ পাতা সরকারি ওষুধ।

ওই দিন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব-৫, রাজশাহীর মিডিয়া উইং জানায়, গ্রেফতারকৃত কাওসার হোসেন ওরফে টিটু জিজ্ঞাসাবাদে চোরাই এসব সরকারি ওষুধ ভারতে পাচার করে তার বিনিময়ে ফেন্সিডিল আমদানি করা হয় বলে স্বীকার করেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাব-৫, রাজশাহী রেলওয়ে কলোনি ক্যাম্পের স্কোয়াডন লিডার মোবাশ্বের রহিম বলেন, এ ধরনের তথ্য আমাদের কাছে আগে থেকেই ছিল। বাংলাদেশী সরকারি ওষুধের বিনিময়ে ভারত থেকে প্রধানত ফেন্সিডিল আনা হয়।

তিনি বলেন, রাশিকুল ও টিটুকে গ্রেফতারের পর তারা র‌্যাবকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান করছেন। হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে চোরাকারবারিসহ পুরো সিন্ডিকেটকে তারা শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন। অল্প সময়ের মধ্যে এ পুরো সিন্ডিকেটের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হবে। আর সে লক্ষ্যইে আমাদের কার্যক্রম চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতরা গোদাগাড়ীর ওয়াহেদ এবং রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এ ওষুধ চুরি সিন্ডিকেটের মূলহোতা বলে র‌্যাবকে তথ্য দিয়েছে। ওয়াহেদ সরকারি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মীদের কাছ থেকে সরকারি ওষুধ সংগ্রহ করে পাচার করছেন। র‌্যাব তাদের কার্যক্রম নজরে রেখেছে।

তবে শুধু এরাই নয়; অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার বাঘা, চারঘাট ও গোদাগাড়ী উপজেলার সীমান্ত এলাকায় আরো অন্তত ১০টি সিন্ডিকেটের ৩০ থেকে ৩৫ জন চোরাকারবারি সক্রিয় রয়েছেন। এরা শুধুমাত্র সরকারি ওষুধ ও জন্মনিরোধক বড়ির বিনিময়ে ভারত থেকে মাদকদ্রব্য আনেন। এদের মধ্যে অন্যতম চারঘাটের ইফসুফপুর এলাকার সিরাজুল ও বাহার আলী এবং গোকুলপুর এলাকার রায়হান আলী ও কুদ্দুস মিয়া। বাঘার মীরগঞ্জ এলাকার সিদ্দিক আলী ও আবদুল ওহাব এবং মুংলি গ্রামের ধীরেন প্রামাণিক।

এ ছাড়া গোদাগাড়ীতে সরকারি ওষুধের বিনিময়ে ভারত থেকে মাদকদ্রব্য আনেন বাগানপাড়া এলাকার তরিকুল ও চর আষাড়িয়াদহ এলাকার ফিরোজসহ আরো অন্তত ১০ থেকে ১২ জন। এরা সবাই সরকারি হাসপাতালের স্টোর কিপারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে ওষুধের চালান সংগ্রহ করেন। তারপর সুযোগ বুঝে সেগুলো সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করেন। এরপর এসব ওষুধের বিনিময়ে দেশে ফেন্সিডিলের বড় চালানের অনুপ্রবেশ ঘটে।

এদিকে ওষুধ চোরাচালানি সিন্ডিকেটের তৎপরতার কারণে গোদাগাড়ীর সীমান্ত সংলগ্ন চরআষাড়িয়াদহ থেকে প্রায়ই সরকারি জন্মনিরোধক বড়ি উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত বছরের ১৩ আগস্ট ১৮ হাজার ৭০০ পাতা ‘সুখি বড়ি’ উদ্ধার হয়েছিল এই চর থেকে। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই ওই চর থেকেই ২০ হাজার ৯৫ পাতা ‘সুখি বড়ি’ উদ্ধার করা হয়।

রাজশাহীর বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেমন ওষুধ চুরি করে মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যের সহযোগিতায় পাচার হচ্ছে সরকারি ওষুধ। তবে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যদের দেনা-পাওনা নিয়ে বনিবনা না হলে মাঝে মধ্যে তারা সীমান্ত এলাকা থেকে কিছু সরকারি ওষুধ ও জন্মনিরোধক বড়ি উদ্ধার করেন।

বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন রাজশাহীর একজন ওষুধ পাচারকারীও। চারঘাটের ওই ওষুধ পাচারকারী বলেন, ‘সবই টাকার খেলা। টাকা দিলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। আর এ তো সরকারি ওষুধ!’

তিনি জানিয়েছেন, ভারতে বাংলাদেশী জন্মনিরোধক বড়ি ও সরকারি ওষুধের ব্যাপক চাহিদা। বিশেষ করে বাংলাদেশী বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ওই দেশের ওষুধের চেয়ে গুণগত মানে অনেক ভালো। ভারতের প্রত্যন্ত সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলোতেই এসব ওষুধ বিক্রি হয়। তুলনামূলক কম দামে ভালো ওষুধ পেতে সীমান্ত এলাকার গ্রাম্য চিকিৎসক ও ফার্মেসি মালিকরা ওই দেশের স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশী ওষুধের চাহিদা দেন। ভারতের মাদক ব্যবসায়ীরা এরপর বাংলাদেশী মাদক ব্যবসায়ীদের ওষুধ পাঠাতে বলেন। এরপর বাংলাদেশী সিন্ডিকেট সরকারি ওষুধ সরবরাহ করে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গ্রাম পর্যায়ের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাঠকর্মীদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে এসব ওষুধ ও জন্মনিরোধক বড়ি সংগ্রহ করা হয়।

সরকারি ওষুধ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাচার হওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়ার জন্য রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. ফেরদৌস নিলুফারের সঙ্গে বেশ কয়েকবার মোবাইলে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভি না করায় বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

এ ব্যাপারে র‌্যাব-৫, রাজশাহীর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহাবুব আলম বলেন, ভারতে ওষুধ পাচারের বিষয়টি গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। তারা ওষুধের বিনিময়ে ভারত থেকে ফেন্সিডিল আনছে বলে যে তথ্য দিয়েছে, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। আর এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্তদের শনাক্তের জন্য র‌্যাবের ইনটিলেজেন্স উইং কাজ করছে। আমরা আশাবাদী, অচিরেই এ সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

বিষয়টি জানার জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র এক নম্বর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, সরকারি ওষুধ ভারতে পাচারের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে মাঝে-মধ্যে জন্মনিরোধক বড়ি সীমান্ত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে ওষুধ পাচারের ঘটনা ঘটলে তা প্রতিরোধে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।