সফল সবজি চাষী থেকে একজন উদ্ভাবক বাবুল কোম্পানি

নিউজ নাইন২৪ডটকম, কুষ্টিয়া: বাবুল কোম্পানি কোন বড় কোম্পানির নাম নয়। গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের নাম ও ধাম বাবুল কোম্পানি। বাবা মোতালেব সর্দার ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভূমিহীন নিরক্ষর সফল সবজি চাষী সশিক্ষিত বিজ্ঞানী বাবুল কোম্পানি হিসেবে নিজেই গর্বিত।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের ছাতিয়ান মালিথাপাড়া গ্রামের বাবুল সর্দার ওরফে বাবুল কোম্পানি (৪০) এলাকার কৃষকদের এখন আদর্শ।

ভূমিহীন নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বপ্ন দেখেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। এলাকার দৃষ্টান্ত হবেন সবজি চাষ করে। এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন তিনি।

২০০০ সালের শুরুতে ছাতিয়ানের তাজ আলী মালিথার এক বিঘা জমি ৪ হাজার টাকা লিজ নিয়ে ফুলকপি লাগানোর মধ্য দিয়ে অন্যের বাড়িতে গোলামি ছেড়ে সবজি চাষ শুরু করেন। পরের বছর একই গ্রামের বগা বিশ্বাসের কাছ থেকে ৮ হাজার টাকায় দুই বিঘা জমি লিজ নিয়ে বেগুন, লাউ ও বাঁধাকপি, পর্যায়ক্রমে অঞ্জনগাছীর খোকনের কাছ থেকে দুই বিঘা জমি লিজ নিয়ে কলাবাগান, ছাতিয়ানের ছানু মেম্বরের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকায় চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে করলা, কদু, বাঁধাকপি, অঞ্জনগাছীর সিআই হাজীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কলাবাগান, লাউ, চিচিঙ্গা এবং অঞ্জনগাছীর ধুন্দার কাছ থেকে ২৫ কাঠা জমি ৭ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে পুঁইশাকের আবাদ করেন।

সরকারি/বেসরকারি কোনো ঋণ বা অনুদান ছাড়াই একসঙ্গে এতগুলো জমি লিজ নিয়ে ভূমিহীন বাবুল এলাকায় সবজি চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটান। এলাকার মানুষ বাবুলর সবজি চাষের সাফল্য দেখে বাবুল সর্দারকে ডাকতে শুরু করেন ‘বাবুল কোম্পানি’ নামে। সেই থেকে ‘বাবুল কোম্পানি’ হিসেবেই পরিচিতি তার।

বাবুলর সবজি চাষের সাফল্যের সংবাদ শুনে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে প্রথম বাবুলর সবজি ক্ষেত পরিদর্শনে যান তৎকালীন মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (বর্তমানে ফরিদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিটিউটের অতিরিক্ত পরিচালক) আজম খান। পরবর্তীতে মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোল্লা মাহমুদ হাসান (বর্তমানে তথ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব) বাবুল কোম্পানির সবজি চাষে সাফল্যের গল্পে মুগ্ধ হয়ে মিরপুর উপজেলা পরিষদের আবাসিক এলাকার পরিত্যক্ত জমি চাষের ব্যবস্থা করেন। সে সময়ের কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক নূরুল ইসলামও বাবুলর সবজি ক্ষেত পরিদর্শন করেন।

বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজাদ জাহান উপজেলা পরিষদের আবাসিক এলাকায় বাবুলর সবজি চাষের জন্য পূর্বের ইউএনওর বরাদ্দকৃত জমির আবাদ অব্যাহত রেখে বাবুলকে সহায়তা করছেন।

বাবুল এখন শুধু সবজি চাষীই নন, একই সঙ্গে ঢেঁড়শ গাছ থেকে পাটের বিকল্প আঁশ উদ্ভাবন করে নাম লিখিয়েছেন বিজ্ঞানীর খাতায়।

২০১১ সালের শেষের দিকে বাবুল কোম্পানি ঢেঁড়স গাছ থেকে পাটের মতো আঁশ উদ্ভাবন করে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। দেশের সব ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া বাবুলর ঢেঁড়স গাছ থেকে পাটের মতো আঁশ উদ্ভাবনের সংবাদটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। স্থান পায় শাইখ সিরাজের মাটি ও মানুষের কৃষি পত্রিকায়।

জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি ২০১২ ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত খামারবাড়ীতে দেশের সশিক্ষিত উদ্ভাবকদের নিয়ে দ্বিতীয় জনবিজ্ঞান উদ্ভাবন মেলার আয়োজন করে। দুদিনব্যাপী এই উদ্ভাবনী মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫ জন সশিক্ষিত উদ্ভাবক অংশ নেন। উদ্ভাবনী মেলায় অংশগ্রহণকারী উদ্ভাবকদের উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বাবুল কোম্পানির পাটের বিকল্প ঢেঁড়সের আঁশ উদ্ভাবন।

পরে ২০১৪ সালের ২৭-২৮ জানুয়ারি ঢাকার খামারবাড়ীতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জনবিজ্ঞান উদ্ভাবন মেলার স্টল পরিদর্শনে এসে প্রধানমন্ত্রীর পিএস-১ নজরুল ইসলাম খান বাবুলর সবজি চাষের সাফল্য ও পাটের বিকল্প ঢেঁড়শ আঁশ উদ্ভাবনের গল্প শুনে রীতিমতো মুগ্ধ হন ও বাবুলকে কৃষি গবেষণার কোনো কাজে লাগানো যায় কিনা সে বিষয়ে তার আগ্রহের কথা জানান।

২০১২ সালে জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন থেকে একজন উদ্ভাবক হিসেবে তাকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তার প্রদানের কথা বলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী সব কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও জনবিজ্ঞানের দেওয়া প্রতিশ্রুতির সেই টাকা আজও পাননি বাবুল কোম্পানি। অবশ্য আর্থিক সহায়তা না পেলেও থেমে নেই বাবুল কোম্পানির পথচলা।

এরই মধ্যে তিনি কলাগাছ থেকে রাসায়নিক সার, আতা ও নিমপাতা থেকে কীটনাশক তৈরি, ঢেঁড়স গাছ থেকে পাটের আঁশ ও বেগুন গাছে টমেটো তৈরির উদ্ভাবক হিসেবে দেশব্যাপী সাড়া ফেলে দেন। তিনি বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে দুবার সেমিনারে অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

বাবুল কোম্পানি এখনও অব্যাহত রেখেছেন কীভাবে কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই সবজি আবাদ করা যায় সেসব গবেষণা নিয়ে।

বাবুল কোম্পানি জানান, শুধু মানুষের জন্যই আমার এ প্রচেষ্টা। আমি সবাইকে দেখাতে চাই, বর্তমান সময়েও রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়াই ভালো সবজি উৎপাদন করা সম্ভব।

তিনি আরো জানান, ভূমিহীন হওয়ায় তাকে কোনো ব্যাংক ঋণ দেয়া হয় না। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পাননি এখন পর্যন্ত। জনবিজ্ঞানের ঘোষণামতো আড়াই লাখ টাকাও হাতে পাননি তিনি। ২০১৪ সালে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের তরফ থেকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা ছিল, তাও দেওয়া হয়নি।