অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মৃতিচারণ করলেন প্রধান মন্ত্রী

ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মমতায় সব হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করছিলেন অত্যন্ত ভাবগাম্ভির্যপূর্ণভাবে।

কাঁদো কাঁদো গলায় বলছিলেন, ‘কি দুর্ভাগ্য আমার। মাত্র ১৫ দিন আগে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় মা আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই শেষ দেখা।

মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমি এখনও খুঁজে পাই না কী কারণ ছিলো এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় চায়নি, যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই চক্রান্ত ছিলো এ হত্যাকাণ্ড। স্বাধীনতার পর তারাই চেয়েছিল বাঙালি জাতির আর্দশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে।

৭৫ এর ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, মাত্র পনের দিন আগে দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়েছিলাম। ১৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু যাওয়ার কথা। তাই বিদেশ আমি যেতে চাইনি। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দেশ ছাড়ি। আমার সঙ্গে রেহানাকেও দেওয়া হয়।

নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে সর্বশেষ মায়ের সঙ্গে কথা হয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় ১৩ আগস্ট। মা তখন বলেছিলেন, তুই আয় তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। কিন্তু সে কথা আর শোনা হয়নি।

শেখ হাসিনা বলছিলেন, আমরা যখন কোথাও যেতাম, আব্বা ও মাকে চিঠি লিখতাম। রেহানা চিঠি লিখতে পছন্দ করতো। আমরা চিঠি লিখেছি কিন্তু সে চিঠি আর কোনোদিন পৌঁছায়নি।

বক্তব্যের শুরুতেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। তার বক্তব্যের শব্দ ছাড়া গোটা হল রুমে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। প্রধানমন্ত্রী কাঁদো কাঁদো গলায় বক্তব্য রাখছিলেন। বক্তব্যের মধ্যে একটি শব্দ বলছেন কিংবা একটি বাক্য বলেই থেমে যাচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকছেন। নিজের কান্না, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিলেন। ভারী উচ্চারণ, চোখের জল, মলিন চেহারা- বেদনার ক্ষত কতো গভীর তার জানান দিচ্ছিলো।

১৫ আগস্ট বেলজিয়ামে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা তখনও জানি না ঢাকায় কী হচ্ছে, তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল জোসেফ টিটো আমাদের খোঁজ নিলেন, খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন মিসেস গান্ধীও। কিন্তু আমাকে কোনো খবর দেওয়া হয়নি।

‘তবে ওখানকার টেলিভিশনে খবর দেখে আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, আব্বা নেই। বাকিরা কে কোথায় আছেন তা জানি না। সেখানে অ্যাম্বাসেডর সাহেব আমাদের কোনো সহযোগিতা করছেন না। আমরা যেনো তার বোঝা হয়ে গেলাম।’

‘এরপর আমরা দিল্লিতে আসলাম ২৪ আগস্ট। আমরা তখনও জানি না কতো বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। ০৪ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানালেন, আমাদের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। আমি ভেবেছিলাম মা, শেখ রাসেল ওরা হয়তো বেঁচে আছে। কিন্তু কেউ নেই।’

দেশে ফেরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ফিরতে চাইলাম। এর মধ্যে জানতে পারলাম, আমাদের ঢাকায় ফিরতে দেওয়া হবে না। জিয়াও চাইছে, আমরা যেনো দেশে না আসতে পারি। আমরা রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে থেকে যাই। ৮১ সাল পর্যন্ত বিদেশে থাকতে হলো।

ছোট বোন রেহানার বিয়েতে থাকতে না পারার কষ্টের কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে বলেন, পরিবারে একমাত্র আমিই জীবিত সদস্য। রেহানার বিয়ের সময় আমি যেতে পারি নাই। যেতে পারি নাই একটাই কারণে। টিকেটের খরচ জোগাড় করা, লন্ডনে গিয়ে থাকার খরচ কাছে ছিলো না। কার কাছে বলবো। কারও কাছে চাইবো সেটা স্বভাবে ছিলো না। কারও কাছে হাত পাতার… কিছু নেওয়া…কষ্ট করে বুকে চেপে রেখেছি কারও কাছে মাথা নত করিনি।’

‘৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় এলেন। উনি শুনলেন, রেহানা সন্তানসম্ভবা… তিনি আমার টিকিটের ব্যবস্থা, থাকার ব্যবস্থা সব করে দিলেন।’

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের দায়িত্বে থাকবো, নেতৃত্বে থাকবো এ চিন্তা করিনি। দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করবো এ আকাঙ্ক্ষা ছিলো।

দেশে ফিরে আসা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ৮১ সালে দেশে ফিরে এলাম। সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলে। লাখো মানুষ জড়ো হয়েছিল। দেশে ফিরে আমার হারানো বাবা-মা, ভাই, স্বজনদের পাইনি। কিছুই পাইনি। কিন্তু পেয়েছি বাংলার মানুষের ভালোবাসা, নেতা-কর্মীদের পাশে পেয়েছি।

দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ভবনে ঢুকতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতে চেয়েছিলাম মিলাদ পড়াবার জন্যে। জিয়া তখন রাষ্ট্রপতি, কিন্তু যেতে দেওয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান যতোদিন বেঁচে ছিলেন বাড়িতে আমাদের যেতে দেওয়া হয়নি। বিনিময়ে অনেক কিছু দিতে চেয়েছিল। একজন খুনির কাছ থেকে কিছু নেওয়া আমার রুচিতে ছিলো না।

শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন দিল্লিতে ছিলাম জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির হিসেবে সফরে গিয়েছিল। বারবার আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছে। আমি দেখা করি নাই।

‘৮০ সালে যখন লন্ডনে, তখনও জিয়াউর রহমান লন্ডনে গিয়ে দেখা করতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, খুনির চেহারা আমি দেখতে চাই না।’

সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় দলটির শীর্ষ নেতারা বক্তব্য রাখেন।