খালেদার ৪ মাসের জামিন

ঢাকা: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চার মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট। সোমবার বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারক সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তার জামিন আদেশ দেয়। গতকাল রোববার আদেশের জন্য দিন ধার্য থাকলেও নিম্ন আদালত থেকে নথি না আসায় আদেশের জন্য আজকের দিন ধার্য করে হাইকোর্ট।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে আদেশের জন্য দিন ঠিক করেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি শেষ হয়।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি একই বেঞ্চ খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদ-ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। এ ছাড়া এই মামলায় নিম্ন আদালতের দেয়া অর্থদ- স্থগিত করা হয়। পাশাপশি নিম্ন আদালতের নথি ১৫ দিনের মধ্যে পাঠাতে ঢাকা বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারককে নির্দেশ দেয়া হয়।

এর আগে খালেদার ৮৮০ পৃষ্ঠার জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। বয়স, শারীরিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনাসহ ৩২টি যুক্তি দেখানো হয়।

আদালতের ভাষ্য-
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের শুনানিতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সাড়ে তিন বছর জেলে থাকার প্রসঙ্গে আদালত বলেছেন, ‘উনি (এরশাদ) সামর্থ্যবান ছিলেন। তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে বিয়েও করেছিলেন, কিন্তু খালেদা জিয়া ফিজিক্যালি ফিট না।’
সোমবার বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারক সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

শুনানির শুরুতেই খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনারা কিছু বলবেন কি?’
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড (মামলাটি) শুনানি শেষে আদেশের জন্য (অপেক্ষায়) রয়েছে।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘আপনারা তো অনেক বই নিয়ে আসলেন, কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।’
এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘মি. অ্যাটর্নি, আপনি কিছু বলবেন?’
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মাই লর্ড, এটি একটি সেনসিটিভ (স্পর্শকাতর) মামলা। এ মামলার নথি ইতোমধ্যে এসে গেছে। তাই, নথি দেখে শুনানির পর আদেশ দেয়া হোক।’

আদালত বলেন, ‘কী ধরনের সেনসিটিভ মামলা?’
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি একটি দুর্নীতির মামলা। এখানে এতিমের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আত্মসাৎ হয়েছে। সাবেক নথিতে সব পরিষ্কার, কীভাবে টাকা আত্মসাতের জন্য উত্তোলন করা হয়েছে। তাই আমি বলব, এ মামলার আদেশ আরো দুই দিন পর দেয়া হোক।’
এ সময় খালেদার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) আইনজীবী জামিন না দেয়ার জন্য ইতোপূর্বে দুটি যুক্তি দিয়েছিলেন। আমরা এসব মামলার নথি এনেছি। এখানে দেখা গেছে, ওই সব মামলায় আসামিদের হাইকোর্টের একক বেঞ্চ জামিন দিয়েছিল।’ এই বলে তিনি আদালতে দুটি মামলার নথি বাড়িয়ে দেন।
এ সময় আদালত দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খানকে বলেন, ‘আপনি কিছু বলবেন?’

তখন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘এ মামলায় উনি (খালেদা জিয়া) সব মিলিয়ে দেড় মাসের মতো কারাভোগ করছেন। উনি এ মামলায় প্রধান অভিযুক্ত আসামি। এক বছর বা দুই বছর জেল হলে কথা ছিল। সাজার পরিমাণ কম, এই বিবেচনায় জামিন দেয়া উচিত হবে না। এটা জামিন দেয়ার গ্রাউন্ড হতে পারে না। তার (খালেদা জিয়ার) শারীরিক অসুস্থতার বিষয়ে কোনো মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেখানো হয়নি।’

এ সময় আদালত বলেন, ‘এ শুনানি তো আপনি আগেও করেছেন। নতুন কী আছে সেটা বলুন।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতে বলেন, ‘আগে খালেদা জিয়া অসুস্থ ছিলেন। এই অসুস্থতার কারণে তিনি হাঁটা-চলা করতে পারেননি।’

এ সময় আদালত দুদকের আইনজীবীকে বলেন, ‘উনাকে পাঁচ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। আপনারা কি রায়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?’
জবাবে খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আমরা রায়ে অসন্তুষ্ট।’
আদালত বলেন, ‘আপনারা কোনো আপিল করেছেন?’

জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘আমরা রায়ের নথি দেখছি। কেননা এ মামলায় আপিল করার জন্য ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সময় রয়েছে।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘সোজা কথায় বলেন, আপনারা রায়ের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না?’
জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, ‘এখনো নিইনি, তবে আমরা রায়ে সন্তুষ্ট না।’
এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘উনি তো (খালেদা জিয়া) ফিজিক্যালি ফিট না।’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘প্রাক্তন একজন প্রেসিডেন্টও (হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ) সাড়ে তিন বছর জেলে ছিলেন।’
পরে আদালত বলেন, ‘ওই সময় উনার বয়স কত ছিল?’
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ’উনার বয়স ৬৫ কিংবা ৬৬ হবে।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘উনি তো অনেক সামর্থ্যবান ছিলেন। উনি পরে কারাগার থেকে বের হয়ে বিয়ে করলেন। আল্লাহর রহমতে একটি পুত্র সন্তান লাভ করেছেন।’ এ সময় বিচারকক্ষে কিছুটা হাসির রোল পড়ে যায়।
এ সময় আদালত বলেন, ‘যাই হোক আমরা আদেশ দিচ্ছি।’
আদালত বলেন, ‘আমরা আইনজীবীদের শুনানিগুলো লিখিত আদেশে দিয়ে দেব। এখানে শুধু আদেশ দিচ্ছি।’

পরে আদালত চারটি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার চার মাসের জামিন আদেশ দেন এবং চার মাসের মধ্যে পেপারবুক তৈরির জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশ দেন।
কুমিল্লার মামলায় খালেদাকে গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ আদালতের-
কুমিল্লা সংবাদদাতা: নাশকতার মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।সোমবার কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মোস্তাইন বিল্লাহ এ আদেশ দেন।

কুমিল্লার আদালত পরিদর্শক সুব্রত ব্যানার্জি জানায়, কুমিল্লার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে গুলশান থানার পুলিশ এসে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক তা মঞ্জুর করে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।

আদালত পরিদর্শক বলেন, সে আদেশ এরই মধ্যে কুমিল্লার কেন্দ্রীয় কারাগারে দেয়া হয়েছে। কুমিল্লার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তা ঢাকার কারাগারে পাঠানো হবে। সেখানে কারাকর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী কায়ইুম হক রিংকু একই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ডাকা অবরোধ চলাকালে ওই দিন দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগমোহনপুরে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে দুর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। মুহূর্তের মধ্যে বাসটিতে আগুন ধরে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। সে সময় বাসের কয়েক যাত্রী জানালা দিয়ে লাফিয়ে প্রাণে বাঁচতে পারলেও দগ্ধ হন অন্তত ২০ যাত্রী। তাদের মধ্যে আটজন নিহত হন।

এ ঘটনায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, প্রয়াত এম কে আনোয়ার, ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সালাউদ্দিন আহমেদ এবং মামলার প্রধান আসামি জামাতের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ তাহেরসহ ৭৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পরবর্তী সময়ে সে মামলার অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয় আদালত।