গণিত প্রশ্নও ফাঁস- চরম দুর্নীতিতে ডুবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
ঢাকা: এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বাংলা এবং ইংরেজি (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র), ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার পর এবার গণিতের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে টানা ৬টি পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হলো। শনিবার সকাল ৮ টা ৫৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে গণিতের ‘খ-চাঁপা’ সেটের প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়, যা অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
শনিবার সকাল ১০টায় এসএসসি ও সমমানের গণিত পরীক্ষা শুরু হয়ে দুপুর ১ টায় শেষ হয়। এর আগে সকাল ৮ টা ৫৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের ‘ঝঝঈ ফ্রি প্রশ্নের দুকান’ নামের একটি গ্রুপে গণিতের বহুনির্বচনি অভীক্ষার ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়। এর সঙ্গে ছিল হাতে লেখা উত্তরপত্র। ফারহান আদনান নামের একটি আইডি থেকে এই প্রশ্নপত্রটি গ্রুপে দেয়া হয়। এসময় উত্তরপত্রও দেয়া হয় ওই আইডি থেকে।
এরপর ফেসবুকসহ অন্যান্য সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নপত্রটি ছড়িয়ে পড়ে। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে ওই প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন একই কায়দায় ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায়। বাংলা প্রথম পত্রের বহুনির্বচনি অভীক্ষার ‘খ’ সেট পরীক্ষার প্রশ্নও ফেসবুকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে পাওয়া যায় সে প্রশ্ন।
৩ ফেব্রুয়ারি সকালে পরীক্ষা শুরুর প্রায় ঘণ্টা খানেক আগে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের নৈর্ব্যক্তিক ‘খ’ সেটের উত্তরসহ প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় ফেসবুকে। যার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
আর ৫ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা শুরুর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে সকাল ৮টা ৪ মিনিটে ইংরেজি প্রথমপত্রের ‘ক’ সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়। যার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
৭ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা শুরুর অন্তত ৪৮ মিনিট আগে সকাল ৯টা ১২ মিনিটে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্রটি হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে পাওয়া গেছে। যা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
একইভাবে ৮ ফেব্রুয়ারি ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্রটিও পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে পাওয়া যায়।
প্রশ্নফাঁস ও দুর্নীতিতে ডুবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-
অব্যাহত প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে ডুবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর তাই মন্ত্রণালয়ের ভাবমর্যাদা উদ্ধারে এগিয়ে আসছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পর থেকে টানা শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। শুরুর দিকে তার ইতিবাচক ভাবমর্যাদা সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছিল। দায়িত্ব নেয়ার দেড় বছরের মধ্যে ২০১০ সালের জুনে ১৬ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেন তিনি। কিন্তু তার সাবেক এপিএস নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মন্ত্রণালয়ে গড়ে ওঠে দুর্নীতির শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে যোগ হয় ধারাবাহিক প্রশ্নফাঁস। সব মিলিয়ে মন্ত্রণালয়ের ক্লিন ইমেজে ভাটা পড়তে থাকে।
জানা গেছে, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে স্বোচ্চার ছিলেন তৎকালীন বাম নেতা নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর তার প্রতি। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় নাহিদকে। স্থান দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদেও।
বছরের প্রথম দিন প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটিও বেশি শিক্ষার্থীর হাতে ৩৫ কোটি নতুন বই তুলে দেয়াসহ শিক্ষায় সরকারের ব্যাপক সাফল্য রয়েছে। তবে প্রশ্নফাঁসে সরকারের সব সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে। শুধু চলমান এসএসসি পরীক্ষাই নয়। নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পরে প্রশ্নফাঁস মহামারী আকার ধারণ করেছে। কার্যত কোনো উদ্যোগেই বন্ধ করা যায়নি প্রশ্নফাঁস। সংসদ থেকে শুরু করে সর্বত্র মন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রীর সমালোচনার ঝড় উঠছে। এ নিয়ে বিব্রত সরকার।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দীন আহমেদ বাবলু গত সোমবার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। এমনকি যাদের পরামর্শ নিতে নাহিদ নিজেই একটি কমিটি গঠন করেছিলেন, সেই শিক্ষাবিদরাও এখন তার সমালোচনায় সরব।
ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে ১৪ জনের দপ্তর বদল করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যদর্শনে আসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। এ লক্ষ্যে চলছে জোর প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন উইংপ্রধানদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মহিউদ্দীন খান বলেন, মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যদর্শনে আসবেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে জানানোর পর সবাইকে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছি। তবে সময় ও তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের প্রস্তুতি চলছে।
জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে ব্যর্থতা; কোচিং বিস্তার, শিক্ষা আইন তৈরিতে গড়িমসির কারণ নির্ণয়; শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তিতে হয়রানি দুর্নীতি; বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি; সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অমান্য; মন্ত্রণালয়াধীন দপ্তরÑ মাউশি, ডিআইএ, বিভিন্ন প্রকল্প, শিক্ষাবোর্ড, এনসিটিবির কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ নেবেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে ২৮৩টি কলেজ সরকারি করতে গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড়ের সম্মতির পরও কেন সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয়নি? এ নিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষক সমিতি ও জাতীয়করণের তালিকায় থাকা শিক্ষকরা পৃথক কর্মসূচি পালন করেন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে নানা ভোগান্তি ও দুর্নীতি, এমনকি প্রতিবন্ধকতার অভিযোগও আছে। নিজের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা অন্তত ১০ জন সহকারী সচিব হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে তারা অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব হয়েছেন। তবে তদবির করে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়েই রয়ে গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন একই মন্ত্রণালয়ে থাকার কারণে তারা গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটই দুর্নীতির হোতা। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা।
গত ২৪ ডিসেম্বর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক অনুষ্ঠানে ‘সহনীয় মাত্রায়’ ঘুষ খাওয়ার ফর্মুলা দিয়ে সমালোচিত হয় শিক্ষামন্ত্রী। পরে অবশ্য সংবাদ সম্মেলন করে এর ব্যাখ্যা দেন তিনি। ‘সহনীয় মাত্রায় দুর্নীতি’র আলোচনা থামতে না থামতেই জানুয়ারিতে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চমান সহকারী নাসির উদ্দিন ঘুষ নেয়ার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন। ২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। ব্যর্থতার দায়ে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের কথা ওঠে সংসদ ও রাজপথে।