সৌদি আরবের প্রক্সি যুদ্ধে যোগদানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ইরানের হুশিয়ারি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:পাকিস্তানের সীমান্ত লাগোয়া অশান্ত সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ইরানি বালুচ জঙ্গিরা হামলা চালানোর পর ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কোর- কুদস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলেইমানি ও অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের কাছ থেকে পাকিস্তান কঠোর হুশিয়ারি বার্তা পেয়েছে। ছয় মাস আগে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশটি সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রেক্ষাপটে তেহরানের এই নতুন সুর শোনা গেলো।

পাকিস্তান থেকে ইরানের পূর্ব সীমান্তে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রক্সি যুদ্ধ চালানো হচ্ছে তা নিয়ে তেহরান গভীর উদ্বিগ্ন। গার্ড কোর কমান্ডারদের হুশিয়ারির মাধ্যমে তেহরান যে বার্তা দিতে চাচ্ছে তা হলো- পাকিস্তানকে নজরে রেখে এ ধরনের তৎপরতা প্রতিরোধ। মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে ইরানের বিরুদ্ধে কোন সৌদি-আমিরাত প্রচেষ্টায় যুক্ত হলে পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হবে।

ইরানি বালুচিস্তানে হামলা চালায় জয়সুল আদল বা ‘ন্যায়ের বাহিনী’ নামে একটি জঙ্গি দল, যাদেরকে সৌদি আরব সহায়তা দিচ্ছে বলে ইরান মনে করে। ওই হামলার পাঁচ দিনের মাথায় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মেহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)-কে লাল গালিচা সম্বর্ধনা দিয়ে স্বাগত জানান ইমরান খান। এমন এক সময় এই সম্বর্ধনা দেয়া হয় যার মাধ্যমে পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দেন যে তিনি তার পূর্বসূরি নওয়াজ শরিফের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় রকমের বিচ্যুতি ঘটিয়েছেন। তৃতীয় মেয়াদে, ২০১৩-১৭ সালে, ক্ষমতায় থাকাকালে শরিফ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিকে সৌদি আরবের প্রতি ঝোঁক থেকে সরিয়ে এনেছিলেন এবং রিয়াদ ও তেহরানের ব্যাপারে অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তান ওই পরিবর্তনকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলো কারণ ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে চীন দেশটিতে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর (সিপিইসি) নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা করা হয়, যা এখন ৬০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ভারত মহাসাগরের উপকূলে গভীর সমুদ্র বন্দর গোয়াদার থেকে চীনের সর্ব পশ্চিমের শহর শিনঝিয়াংয়ের কাশগর পর্যন্ত এই করিডোর বিস্তৃত।

এই প্যাকেজের অংশ হিসেবে চীন ইরান-পাকিস্তান (আইপি) গ্যাস পাইপ লাইনের পাকিস্তান অংশের বেশিরভাগ নির্মাণ করে দিতে রাজি হয়। চীন এই প্রকল্পে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে, যা মোট নির্মাণ ব্যয়ের ৮৫% মেটাবে এবং পাইপলাইনটি গোয়াদার বন্দর থেকে নওশাবা পর্যন্ত যাবে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরিণ গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে। আইপি পাইপলাইন জ্বালানি সংকটে থাকা পাকিস্তানকে ইরানের বিপুল সাউথ পার্স ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ করতে পারতো, যা দিয়ে ৪,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এতে পাকিস্তানের বিদ্যুৎ ঘাটতি পুরোপুরি মিটে যেতো।

চীনা বিনিয়োগে ভেসে যাওয়া ও ইরানের কাছ থেকে অতি প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার আশায় শরিফ সরকার ইয়েমেনে রিয়াদের প্রক্সি যুদ্ধে যোগ দিতে একদল পাকিস্তানী সেনাকে পাঠানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলে জানা যায়। তেহরান ও শরিফ সরকারের মধ্যে বৃহত্তর সন্ত্রাস-দমন সহযোগিতার আকারে নীতির এই আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ২০১৪ সালের জুনে পাকিস্তান সেনা বাহিনী শিয়া বিরোধী তালেবান ও অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপারেশন জার্ব-ই-আসব শুরু করে। এসব গ্রুপের অনেকগুলোর সঙ্গে জয়শে আদলের যোগাযোগ ছিলো। জয়সে আদল হলো বালুচ জাতিয়তাবাদী জঙ্গি গ্রুপ জানদাল্লা (ঈশ্বরের বাহিনী)-র উত্তরসূরি। জানদাল্লা ২০০০ সালের দিকে ইরানের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদি তৎপরতা শুরু করে। জার্ব-ই-আসব চলার সময় ইসলামাবাদ ইরানী বাহিনীকে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অভিযান চালানোর অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছিলো বলে জানা যায়। তখন জয়সে আদল জঙ্গিদের ধাওয়া করে ইরানের হেলিকপ্টার ও সাঁজোয়া যান প্রায়ই পাকিস্তানী ভূখণ্ডে ঢুকে পড়তো। ১৯৯৭ সালে শরিফ তার দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামলে তালেবানদের আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু জার্ব-ই-আসব অপারেশন ছিলো ওই নীতির সম্পর্ণ বিপরীত। তালেবানদের আর যে একটি দেশ সমর্থন দিয়েছিলো সেটি ছিলো সৌদি আরব।

ইরানের দিকে পাকিস্তানের এই ঝোঁক ছিলো ক্ষণস্থায়ী। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শরিফ ক্ষমতাচ্যুত হন পানামা পেপার্স কেলেংকারীতে অভিযুক্ত হয়ে। তার উত্তরসূরি হিসেবে ২০১৮ সালের জুনে ক্ষমতায় আসেন ইমরান। তার শাসনামলে পাকিস্তান আবার সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

গত বছরের ২৩ অক্টোবর সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক বেইল আউটের জন্য ৬ বিলিয়ন ডলার প্রদানের কথা ঘোষণা করে। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। বাকি সহায়তা দেয়া হয় তেলের মূল্য বিলম্বে পরিশোধের আকারে। এর ঠিক দুই মাস পর ২১ ডিসেম্বরে আরব আমিরাত ঘোষণা করে যে তারা পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে দেশটির কেন্দ্রিয় ব্যাংকে ৩ বিলিয়ন ডলার জমা রাখছে। সৌদি আরব ও আমিরাতে কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ায় পাকিস্তানের মুদ্রামান অবাধে পতনের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং ইসলামাবাদ আরো সময় নিয়ে আইএমএফ’র সঙ্গে বেইল আউট প্যাকেজের ব্যাপারে আলোচনা করার সুযোগ পায়।

সর্বশেষে ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি সৌদি আরব ঘোষণা দেয় যে তারা সিপিইসি-তে যোগ দিচ্ছে এবং গোয়াদার বন্দরে ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ করবে। সিপিইসিতে যোগদানকারী প্রথম তৃতীয় দেশ হিসেবে সৌদি আরব সুকৌশলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সিপিইসি থেকে ইরানের সুফল লাভের সুযোগ নস্যাৎ করে দেয়। ফলে আইপি গ্যাস পাইপলাইনের ভবিষ্যতও ঝুলে গেছে। পাকিস্তানকে দেয়া সৌদি আরবের বর্তমান সহায়তা ও বিনিয়োগ প্যাকেজের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার, যা আরব আমিরাতের সহায়তার সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অর্থনীতির টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

সম্পর্কের এই পুনর্বিন্যাস ইতোমধ্যে বালুচিস্তানে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি বালুচ সন্ত্রাসীদের হামলায় ৪০ জনের মতো ইরানী গার্ড সদস্য নিহত হয়, যাকে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে চক্র গড়ে ওঠার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছে ইরান। বালুচ সন্ত্রাসীদের সহায়তায় সৌদি আরব ও আরব আমিরাতকে পাকিস্তান ভূমি ব্যবহার করতে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওই হামলার এক সপ্তাহ পর উত্তর ইরানের এক অনুষ্ঠানে জেনারেল সুলেইমানি পাকিস্তান সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন এবং বলেন, ‘পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়েও তোমরা কি কয়েক শ’ সদস্যের সন্ত্রাসী গ্রুপটিকে ধ্বংস করতে পারো না? সন্ত্রাসী দলটিকে সৌদি আরবের অর্থ যোগানোর নিন্দা এবং পাকিস্তানের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে সুলেইমানি পাকিস্তানকে নজরে রাখা হবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ইরানকে পরীক্ষা না করার জন্য আমি আপনাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি। যারাই ইরানকে পরীক্ষা করতে গেছে তারই উপযুক্ত জবাব পেয়েছে। আমি আপনাদেরকে বলে দিচ্ছি পাকিস্তানের সীমান্ত যেন প্রতিবেশি দেশগুলোর জন্য নিরাপত্তাহীনতার কারণ না হয়।

পাকিস্তান এখন আরো গভীরভাবে রিয়াদ ও আবুধাবির সঙ্গে আবদ্ধ হওয়ায় জয়সে আদলের ১৩ ফেব্রুয়ারির হামলা তেহরানে সতর্ক ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। যদিও ইয়েমেনে ইরানী পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট হুতি বাহিনীকে পরাজিত করতে সৌদি আবর ও আমিরাত পাকিস্তানের কাছ থেকে আরো বেশি সহযোগিতা চায়, তাই ইরান-বিরোধী ব্লকটি তেহরানের সঙ্গে সন্ত্রাস-বিরোধী সহযোগিতার ইতি টানতে পাকিস্তানকে চাপ দিতে পারে। এই ন্যূনতম দাবির পাশাপাশি জয়সে আদলের তৎপরতার সমর্থনে পাকিস্তানকে আরো সমন্বিত ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হতে পারে। তখন পাকিস্তান সক্রিয়ভাবে জড়িত হোক বা তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিক, পাকিস্তান-ইরান সম্পর্কের বর্তমান স্থিতাবস্থাটি বদলে যাবে বলে মনে হচ্ছে।