সুইডিশ রাজাকে সিরীয় শিশু আহমাদের মর্মস্পর্শী চিঠি

ডেস্ক: শারাফি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষিকা। তিনি সুইডেনের মালমো শহরের একটি স্কুলে পাঠদান করেন। গত কয়েক মাসে এ শহরে অনেক নতুন লোকের আগমন হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ইরাক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তান থেকে আসা অভিবাসী। তাদের অনেককেই এখানে পৌছাতে অনেক কঠিন অবস্থা অতিক্রম করতে হয়েছে।
এমাসের শুরুর দিকে শারাফি তারই এক অভিবাসী ছাত্রের লেখা একটা মর্মস্পর্শী চিঠি সম্পর্কে জানতে পারেন। যে চিঠিটা সুইডেনের রাজার উদ্দেশ্যে লেখা।

শারাফি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন চিঠিটা লিখেছে আহমেদ নামের তারই এক ছাত্র। সে খুবই চঞ্চল একটি ছেলে যার বয়স মাত্র ১২ বছর। সে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে পালিয়ে পিতামাতা ও ছোট ভাইসহ ইউরোপে এসেছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই আহমেদের লেখা চিঠিটা শারাফির হস্তগত হয়।

তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান, ‘চিঠিটা পড়েই আমি অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। যখন আমি আহমেদকে জিজ্ঞাসা করি কেন চিঠিটা তুমি রাজার উদ্দেশ্যে লিখেছো? তখন আহমেদ সাবলীলভাবে উত্তর দেয়, ‘আমি এদেশের রাজাকে আমার ছোট্ট জীবনের গল্পটা জানাতে চাই।’

তারপর শারাফি আহমেদকে সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তাভের সাথে সাক্ষাতের আশা নিয়ে তার চিঠিটা রাজার দৃষ্টিগোচর করতে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান বেতারগুলোতে প্রচারের চেষ্টা করেন।
কিন্তু সেখানেও আহমেদেকে তার এই স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে। পরে তারা ফেসবুকে  a Facebook page called Brev till kungen বা ‘লেটার টু দ্য কিং’ নামের একটি পেজ খুলেন।

সুইডিশ রাজাকে লেখা আহমাদের চিঠিতে আহমাদ ও তার কাউন্সেলর
সুইডিশ রাজাকে লেখা আহমাদের চিঠিতে আহমাদ ও তার কাউন্সেলর

কি লেখা রয়েছে ঐ চিঠিতে?
‘হে রাজা গুস্তাভ’
‘আমার নাম আহমেদ এবং আমার বয়স ১২ বছর। আমার পরিবারে একজন মা, বাবা ও ছোট ভাই রয়েছে। আমরা সিরিয়ার আলেপ্পোতে আনন্দে পরিপূর্ণ খুবই সুন্দর একটি বাসায় থাকতাম। আমার বাবার একটি বড় কারখানা ছিল এবং বাচ্চাদের পোশাকের একটি দোকান ছিল। তিনি সবসময় আমাদের জন্য অনেক খেলনা ও উপহার নিয়ে আসতেন। আমাদের গাড়িও ছিল এবং যুদ্ধ, মিসাইলের শব্দ, গোলাগুলি ও সন্ত্রাস শুরুর আগে আমরা অনেক আনন্দেই জীবনযাপন করতাম।’
‘একদিন গোলার আঘাতে বাবার কারখানাটা পুড়ে গেল, আমাদের আনন্দের আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। তারপর আমরা অবরোধের অভিজ্ঞতা নিতে থাকলাম। আমার স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল কারণ আমার চোখের সামনেই আমার শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করা হল। আমি সে ঘটনা কখনোই ভুলতে পারবো না। সে মুহূর্তগুলো ছিল আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত।’
‘আমার বাবা ঘরে এসে মা কে বললেন, আমাদের কারখানাটি আগুনে পুড়ে গেছে। মা তখন কাঁদতে কাঁদতে ঘরে থেকে বের হয়ে গেলেন। তখন আমার বাবা আমাদের নিরাপত্তার জন্য এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর থেকেই আমার খারাপ দিনগুলি শুরু হয়। শনিবার ভোরে আমরা তুরস্কে চলে যাই। আমরা একটি নৌকায় চড়ে ভীতিকর নৌভ্রমণে এ পথ পাড়ি দেই।’
‘আমার চারপাশে ছিল জলরাশি এবং মাথার ওপর অন্ধকার। আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম। মানুষেরা চিৎকার করছিল, বাচ্চারা কাঁদছিল। আমার বাবা সবসময় হেসে আমাকে এবং আমার ভাইকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি যেমনটা ভেবেছিলাম তার চাইতেও কঠিন ছিল। আমি নিজের সাথেই কথা বলছিলাম, আমাদের সাথে এসব কি হচ্ছে? কোথায় আমার বাড়ি? কোথায় আমার বিছানা এবং খেলনা?’
‘আমরা একটা দ্বীপে পৌছালাম। পুলিশ আমাদের সেখান থেকে আগের নৌকার চাইতে খারাপ একটি নৌকায় এক জনাকীর্ণ জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানে খুবই ভয়ঙ্কর গাঁদাগাঁদি অবস্থা। পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের সেখানে থাকতে হল। আমরা ঘর ছাড়া ১৫ দিন ছিলাম। সে মুহূর্তটা ছিল আমার সবচেয়ে মন খারাপের। মা বাবার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছিল। তারা আমার জন্যে আগে যা করতেন তা করতে পারছিলেন না।’
‘আমি সর্বদা দূরে গিয়ে কাঁদতাম। আমি চাইতাম না আমার বাবা মা আমাকে এমন অবস্থায় দেখুক, যা দেখে তাদের দুর্দশা আরো বেড়ে যাক। আমার মাও আমার মতই কাঁদতেন। তবে কেউ তা দেখতে পেত না। কিন্তু আমি তাকে দেখেছি। তখন আমার হৃদয় ভেঙ্গে গিয়েছিল।’

‘আমরা সুইডেনে আসলাম। আমি সুইডিশ রাজার সাথে দেখা করে আমার গল্পটি জানাতে চাই। আমি শুনেছি তিনি একজন হৃদয়বান রাজা। আমার সাথে নিয়ে আসা ব্যাগে কিছু নতুন পোশাক রয়েছে যা- তার সাথে সাক্ষাতের সময় আমি তাকে দিতে চাই।’
‘সুইডেনে এসে আমি আমার আন্টির সাথে থাকতে শুরু করি যেটা আমাদের সুন্দর বড় বাসাটি থেকে অনেক ছোট। আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার বাবা জানালার পাশে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। এটা ভেবে যে, পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস তিনি আমাদের কিনে দিতে পারছেন না।’
‘এজন্য আমি আপানার সাক্ষাত পেতে চাই।’
‘আমি আশা করছি আমার নতুন পোশাক পড়ে আপনার সাথে দেখা করতে পারবো, যে পোশাকগুলো আমি সারা পথ বয়ে এই সুইডেনে নিয়ে এসেছি।’
-নিবেদক
আহমেদ
মালমো
‘০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬’

এ চিঠিটা পড়ার পর পিতামাতা এবং শিক্ষক উভয়েরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে এটা আহমেদরই লেখা চিঠি।
পোষ্টকে দেওয়া এক ভিডিও সাক্ষাতকারে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে- যা কিনা তার তৃতীয় ভাষা, আহমেদ জানায়, ‘চিঠিটা লেখা আমার জন্য খুবই কষ্টদায়ক ছিল, কিন্তু লেখার পর নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।’
‘এটা লেখা খুবই কঠিন ছিল, কারণ আমি আমার সিরিয়া থেকে সুইডেনে ভ্রমণ সম্পর্কে লিখেছি।’
‘আমার বাবা জিজ্ঞেস করেছিল এটা আমি লিখেছি কিনা, আমি বলেছি, এটা লিখতে আমাকে কেউ সাহায্য করেনি। আমি নিজেই এটা লিখেছি।’ সূত্র: ওয়াশিংটনপোস্ট