সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ভারতীয় পুলিশের ইতিহাস ও বাংলাদেশী হিন্দু পুলিশদের ভূমিকা

ভারত এবং বাংলাদেশ দুটি রাষ্ট্রই সেক্যুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবিদার। যদিও দুই দেশের ক্ষেত্রেই বাস্তবতা বিপরীত এবং দুই দেশেই মুসলিম সম্প্রদায় নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। একথা সবারই জানা যে, ভারতের মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে উগ্র হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। প্রায়শই হিন্দুদের দ্বারা মুসলিম হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি দাঙ্গায়, প্রতিটি নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনায় হিন্দু পুলিশের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ১৯৪৭-এ ভারত যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণহারে মুসলিম নিধন শুরু হয়েছিল দেশটিকে মুসলিমমুক্ত করার উদ্দেশ্যে। বাংলা, পাঞ্জাব ও দিল্লিতে হিন্দু ও শিখরা ভয়াবহ মুসলিম নিধন শুরু করেছিলো, যার নজির ইতিহাসে বিরল। সেই দাঙ্গায় হিন্দু পুলিশ বাহিনী পালন করেছিলো মূল দাঙ্গাকারীর ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘দাঙ্গার ইতিহাস’ গ্রন্থের ৭১-৭৩ পৃষ্ঠাতে উল্লেখ করা হয়েছে- “দিল্লিতে যা ঘটে তার পিছনে শহরের তাবৎ হিন্দু ও শিখ জনসাধারণের নৈতিক সম্মতি ছিল আর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নৈতিক সম্মতিরও বেশি কিছু ছিল এসব ঘটনা ঘটার পেছনে। …দাঙ্গার শেষ পরিণতি হলো-তিন চারদিন পর ঐ অঞ্চলে একজন মুসলমানের চিহ্ন রইলো না। …শিখ, হিন্দু পুলিশ ও সেনাবাহিনীরা মিলিতভাবে মুসলমানদের দিল্লি থেকে উৎখাত করে।”

‘দাঙ্গার ইতিহাস’ গ্রন্থের ১০০-১০২ পৃষ্ঠায় ভারতের জামশেদপুর দাঙ্গা প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে-
“জামশেদপুর ভারতের প্রখ্যাত শিল্পাঞ্চল। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা। …পুলিশ দাঙ্গা থামাবে কী, উল্টো তাদের একটি বড় অংশ দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুসলিম নিধন, পীড়ন ও তাদের ধনসম্পত্তি বরবাদের কাজে মত্ত হয়ে উঠলো।”
১৯৮০ সালে ১৩ই আগস্ট ঈদুল ফিতরের দিন। ভারতের উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ ঈদগাহ ময়দানে পুলিশ নিরাপত্তা দেয়ার নামে অবস্থান করে ঈদগাহর প্রবেশদ্বারে। পুলিশের যোগসাজশে ঈদগাহে নামায চলাকালীন সময়ে দলিত হিন্দুরা তাদের বস্তি থেকে একটি শূকর এনে ছেড়ে দেয় নামাযরত মুছল্লিদের মাঝে। পুলিশি পাহারা সত্ত্বেও নামাযের মধ্যে শূকরের মতো নাপাক পশু ঢুকে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানগণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে পঞ্চাশ হাজার মুসল্লির উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে হিন্দু পুলিশবাহিনী। অনেকের সাথে ছিল তাদের শিশুসন্তান। বোঝা’ই যাচ্ছে কি পরিমাণ রক্ত ঝরেছিল সেদিন মোরাদাবাদে।
১৯৯০’র হাসিমপুরা গণহত্যার ইতিহাসও উল্লেখযোগ্য। উত্তরপ্রদেশের সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর হিন্দু সদস্যরা পঞ্চাশজন মুসলিম যুবককে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলিবর্ষণ করে। খালের পানিতে ফেলে দেয়া সেসব লাশগুলো পরবর্তীতে ভেসে উঠে।
১৯৮৯ সালে ভাগলপুরের দাঙ্গায় পুলিশের এক এ.এস.আই.-এর নেতৃত্বে লোগিয়ান গ্রামে ১০৮ জন মুসলমান শহীদ করা হয়, যাদের মৃতদেহ গুম করতে সেগুলো মাটিতে পুঁতে তার উপর রাতারাতি ফুলকপি ক্ষেত তৈরি করা হয়। (তথ্যসূত্র: গোলাম আহমাদ মোর্তজা রচিত ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৬-২৮)

এদিকে ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হিন্দুদের পরিকল্পিত গোধরা কা-ের পর সংঘটিত গুজরাট দাঙ্গায় পুলিশের সাম্প্রদায়িক ভূমিকা পুলিশই স্বীকার করতে বাধ্য হয়। গুজরাটের সেই মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছিলো। তৎকালীন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সঞ্জীব ভাট সুপ্রিম কোর্টে দেয়া হলফনামায় বলেছিলো, “দাঙ্গার সময় দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের না ঠেকাতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলো মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়, হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতি যেন তাদের ক্ষোভ মেটাতে পারে, পুলিশকে সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে।” এমন স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য সঞ্জীব ভাটকে পরবর্তীতে পুলিশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। (সূত্র: দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৯/৮/২০১৫; দ্যা হিন্দু ১৯/৮/২০১৫)

পাঠক! ভারতীয় হিন্দু পুলিশদের মুসলিমবিরোধী ভূমিকার উদাহরণ দিয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করা যাবে। পক্ষান্তরে একই ইস্যুতে ৯৮ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের পুলিশের কী ভূমিকা তাও কারো অজানা নয়।
সম্প্রতি (২০১৬) রাজধানীর বাড্ডায় একটি মন্দিরে পবিত্র কুরআন শরীফ পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশ শৃঙ্খলা রক্ষা করার ভঙ্গিতে মূলত হিন্দুদের প্রটোকল দিয়েছে। র‌্যাব-পুলিশ মন্দির পাহারা দিয়েছে। ঘটনার সাথে জড়িত বিমল চন্দ্র সাধু ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার না করে বরং হিন্দুদের এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারী কর্মকা-ে মৌন সমর্থন জানিয়েছে ও উগ্র হিন্দুদের সাহস যুগিয়েছে। বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের প্রতিবাদকে কঠোরভাবে দমন করেছে। যা গোটা পুলিশ প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
২০১৪ সালে পবিত্র রমযানে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার স্বামীবাগে তারাবীর নামাযে বাধা দেয়াকে কেন্দ্র করে ইসকন মন্দিরের রথযাত্রী এবং মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। হিন্দুরা মসজিদে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ৮ থেকে ১০ জন মুসল্লিকে মারাত্মকভাবে আহত করে। মুসল্লিরা পবিত্র মসজিদে আক্রমণ ঠেকাতে থানা-পুলিশের সাহায্য কামনা করলে ঘটনাস্থলে গে-ারিয়া থানার এসআই অমল কৃষ্ণ উপস্থিত হয়। কিন্তু পুলিশ অমল এসেই সম্পূর্ণরূপে হিন্দুদের পক্ষ নেয়। শুধু তাই নয়, মুসল্লিদেরকে সে এই বলেও হুমকি দিয়ে যায় যে, ‘তারাবীর নামায রাত ১০টার মধ্যেই শেষ করতে হবে অন্যথায় মন্দিরের কার্যক্রমে বাধা দেয়ার কারণে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’

এছাড়াও হিন্দুরা বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পবিত্র দ্বীন ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করে থাকে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ ওই কটূক্তিকারী হিন্দুকে হেফাজত করে এবং তাকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়ার কোনো খবর পাওয়া যায় না। পুলিশের এহেন ভূমিকা দেখে বোঝার বাকি থাকে না যে, ভারত-বাংলাদেশ দুটি দেশ হলেও হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় ও সাম্প্রদায়িকতায় এক ও অভিন্ন। তবে হিন্দুদের খুশি রাখলেই যে সরকার ও প্রশাসনের স্বার্থ হাসিল হবে- এমনটি মনে করলে চরম খেসারত দিতে হবে সরকারকে। যেমনটি এখন সরকারকে বিব্রত হতে হচ্ছে হিন্দু প্রধান বিচারক এসকে সিনহার বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে।