রোহিঙ্গাদের নাস্তিক বানানোর চেষ্টা চলছে : আল্লামা শফি

শুক্রবার। বাদ জুমার পর নগরীর লালদীঘি ময়দানের সমাবেশ এলাকা ধীরে ধীরের কানায় কানায় পূর্ণ হতে থাকে বিক্ষুব্ধ মুসলিম জনতার সম্মিলনে। এক এক করে মিছিল এসে যোগ দিচ্ছে সমাবেশে। চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম নেতারা যোগদান করছেন সমাবেশে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ছিল কঠোর নিরাপত্তা ও নজরদারির ব্যবস্থা। বিভিন্ন উঁচু ভবনগুলো থেকেও ছিল পুলিশের নজরদারি। সমাবেশ ঘিরে প্রায় ১ কিমি জুড়ে লাগানো ছিল মাইক। সেখান থেকে বাজছে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে মুসলিম নেতাদের উত্তপ্ত বাক্য। কড়া সমালোচনা করা হচ্ছে জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও। হেফাজতের সমাবেশ স্থল থেকে দাবি তোলা হয়, রোহিঙ্গাদের নাস্তিক বানানোর চেষ্টা চলছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার আহবান জানান বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনের নেতারা। গতকাল দুপুরের পর থেকে নগরীর লালদীঘি ময়দানে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে এমনই উত্তপ্ত দিন ছিল। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, নির্যাতন এবং তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে এই সমাবেশের ডাক দেয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফি। তবে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের শান্তির জন্য দোয়া কামনা করা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোন বক্তব্য দেননি আল্লামা শফি। সেই দোয়া প্রার্থনার মাঝেই হেফাজতের আমির বলেন, রোহিঙ্গাদের নাস্তিক বানানোর চেষ্টা চলছে। আপনারা খুবই সর্তক থাকবেন। এদের গ্রামে গ্রামে যেন মসজিদ–মাদ্রাসা হয় সে চেষ্টা করবেন। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।

শাহ আহমদ শফি বলেন, ‘রোহিঙ্গা মুসলমানকে আল্লাহ তুমি হেফাজত করো। তাদের ছেলেমেয়ে, পরিবারকে হেফাজত করো। আমাদের ঈমানকে রক্ষা করো।’

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার তৎপরতার বিষয়ে হেফাজতের আমীর এমনটাই মন্তব্য করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে মিয়ানমার সরকারে বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, সু চি এবং সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানের ওপর যেভাবে হামলা করছে এতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় সু চি একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী, জঙ্গি। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদান করতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

সরকারের উদ্দেশ্যে বাবুনগরী বলেন, কূটনৈতিক উপায়ে সু চির সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করুন। তা না হলে মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করুন। এরপরও যদি না হয় সু চির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করুন দেখবেন আপনার পাশে ১৬ কোটি মানুষ পাশে থাকবে। ইনশাল্লাহ। জিহাদ ছাড়া সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন বাবু নগরী।

পরবর্তী কর্মসূচির জন্য মুসল্লি জনতাকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানিয়ে বাবুনগরী বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত আরাকানের মুসলমানরা সে দেশে নির্বাচন করেছে, মন্ত্রী হয়েছে। তারা যদি নাগরিক না হয় তাহলে কেমন করে নির্বাচন হল, কিভাবে মন্ত্রী হলো। সুতরাং আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলামানদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।

হেফাজতে ইসলাম পরামর্শক্রমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে সমাবেশে জানানো হয়। কোন সময় আল্লামা শফি যদি জিহাদের ডাক দেন সে জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানিয়েছেন বাবুনগরী।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, গণহত্যার শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দায় হচ্ছে গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমরা গণহত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছি, তাই যারা গণহত্যার শিকার হয়েছে তাদের আবেগ–অনুভূতি আমরাই বেশি বুঝবো।

তিনি আরো বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, রাশিয়া–চীন সহ আরও কয়েকটি দেশ মিয়ানমারের কথায় গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, চীন–রাশিয়া–মিয়ানমারের ঐক্য মূলত সাম্প্রদায়িক ঐক্য। আমরা বলতে চাই, তাদের ঐক্য গণহত্যার পক্ষে ঐক্য। এই ঐক্য ভাঙতে হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমারের উপর অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দিতে হবে। অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে হবে।

মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে মসজিদ–মাদ্রাসা নির্মাণ করতে হবে। মসজিদ মাদ্রাসায় কেউ হাত দিলে তা ভেঙে দেয়া হবে।

যুগ্ম মহাসচিব সলিম উল্যাহ বলেন, ভারত ও চীন মিয়ানমারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম নির্যাতনকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছে। তারা যদি সংখ্যালঘুদের ওপর এই হত্যা বন্ধে এগিয়ে না আসে, তবে সারা বিশ্বে সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুম নির্যাতন করা হয়, তার দায়–দায়িত্ব তাদেরকে নিতে হবে।

অন্যান্য বক্তারা বলেন, যতদিন রোহিঙ্গারা এ দেশে থাকবে ততদিন তাদের খাওয়া. দাওয়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য যাবতীয় ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। তা যদি না হয় তাহলে আমরা সরকারের বিরুদ্ধে যাব।

আরাকানের স্বাধীনতা ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। স্বাধীন আরাকার রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের এগিয়ে আসার আহবানও জানান বক্তারা।

এছাড়া অষ্টম শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বইয়ে ৫৩ পৃষ্ঠার বিপ্রদাশ বড়ুয়া’র ‘মংডুর পথে’ ভ্রমণ কাহিনী বিষয়ক লেখাকে অবিলম্বে বাদ দিতে হবে বলে সমাবেশে দাবি তোলা হয়।

সমাবেশে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন, হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী, নায়েবে আমির নুর হোসেন কাশেমী, আব্দুল হামিদ, আব্দুল মালেক হালিম, হাফেজ আতা উল্যাহ, যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, সলিম উল্যাহ, জুনায়েদ আল হাবীব, জাফর উল্যাহ খান, সাজেদুর রহমান, মইনুদ্দিন রুহী, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদি, ঢাকা মহানগর সহ–সভাপতি মামুনুল হক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাসনাত আমিনীসহ অন্যান্যরা।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে ফের উত্তপ্ত হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সে সময় থেকে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি সরকারের ওপর চাপও সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। গতকালের কর্মসূচি ঘিরে ছিল পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাদের সতর্ক অবস্থান। সমাবেশ চলাকালীন ও শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার কারণে নন্দনকানস্থ বৌদ্ধ মন্দির সড়কে বন্ধ করে দেয়া হয় যান চলাচল। এ সড়কের উভয় মুখে থাকে পুলিশের সতর্ক অবস্থান।