রিজার্ভ আত্মসাতের নাটের গুরুরা কি ধরা পড়বে?

 

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮১০ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে মঙ্গলবার দিনভর একের পরে এক ঘটনা ঘটে গেল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগের মাধ্যমেই সূত্রপাত এ ঘটনার। রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়টি যথাসময়ে অর্থমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে না জানানোকেই দায়ি করা হয়। এর জের ধরেই পদত্যাগ করেন তিনি। পরেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকে। ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। সরিয়ে দেয়া হয় অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলমকে। কিন্তু ব্যাংক পাড়ায় এখন ওপেন সিক্রেট এ ঘটনার নাটের গুরু এক শীর্ষ কর্মকর্তা এখনও বহাল তবিয়তে।

তাকে পদে রেখে তদন্ত করলে বাকিদের ব্যাপারে অবিচার করা হবে বলেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। রিজার্ভের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জড়িত দেশী ও আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যদের বিচারের আওতায় আনতে হলে এই নাটের গুরুকেও আনতে হবে সামনে।

এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশে রিজার্ভ থেকে যেকোনো লেনদেনের মেসেজ জেনারেট (তৈরি) করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফ্রন্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা। তা যাচাই করে দেখে একই অফিসের অন্য এক কর্মকর্তা। মেসেজ পাঠায় একই বিভাগের আরেক কর্মকর্তা। মিডল অফিসের দুই কর্মকর্তা ফ্রন্ট অফিসের মেসেজ যথাযথ হয়েছে কি না তা তদারকি করে থাকে। রিজার্ভ ম্যানেজমেন্টের জন্য এ দুই অফিস নিয়ন্ত্রণ করে ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট। এই বিভাগের জিএম কাজী ছাইদুর রহমান ও নির্বাহী পরিচালক হলেন আব্দুর রহিম। ডেপুটি গভর্নর-৩ এস কে সুর চৌধুরী হলো এ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

অপর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে রিজার্ভ লেনদেনের ব্যাক অফিস। এই ব্যাক অফিস ফ্রন্ট ও মিডল অফিসের কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না বা পাঠানো বার্তা অনুযায়ী ঠিকমতো রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কেটে রাখা হয়েছে কি না, দেশের রিজার্ভ কী পরিমাণে রয়েছে এগুলো দেখাশুনা করে। প্রতিদিনের হিসাব তৈরি করে। এই বিভাগের জিএম হলেন বদরুল হক খান ও নির্বাহী পরিচালক হলেন মাসুম কামাল ভূঁইয়া। এ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হলেন ডেপুটি গভর্নর-১ আবুল কাসেম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ ও ফিনান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টর নির্বাহী পরিচালক হলো শুভংকর সাহা। এসব বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হলেন ডেপুটি গভর্নর-৪ নাজনীন সুলতানা।

এর বাইরে বাংলাদেশের ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ) জিএম হলেন নাসিরুজ্জামান ও নির্বাহী পরিচালক নওশাদ আলী চৌধুরী । এর বাইরেও ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন এক্সচেঞ্জ ইন্সপেকশন (বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থা পরিদর্শন বিভাগ) এর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হলেন ডেপুটি গভর্নর-২ আবু হেনা রাজি হাসান।

বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার কাজটি করে এই কয়টি বিভাগ ও তার কর্মকর্তারা। এই কয়টি বিভাগকে নিয়েই তদন্ত হলে মূলহোতাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। তদন্ত কয়েক ব্যাক্তিকে নিয়ে করা হলে এই চক্র আরো জেঁকে বসবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সুযোগ তৈরি হবে তাদের, এমন আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটির চুলচেরা হিসেব খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ আরও দুটি দল। আইটির বিষয়টি দেখছে তদন্ত কর্মকর্তার চোখে সন্দেহ ভাজন ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা ও তারই সুপারিশে সদ্য নিয়োগ পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ার-আই নামক প্রতিষ্ঠান। র‌্যাব আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেছে। এর বাইরেও ৩টি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। নজর রাখছে দুদকও।

ফরেক্স রিজার্ভের ডিলিংরুমের(যেখান থেকে বৈদেশিক রিজার্ভের অর্থ লেনদেন করা হয়) দুটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বন্ধ ছিল দুই দিন আগে থেকেই। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে তদন্তকারিরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টারনেট ক্যাবলে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ডাটা ট্রান্সফার ও ইউজার হিস্টোরির তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

তদন্তকারী দল বলছে, এ কাজে ব্যবহৃত ৪টি ইউজার আইডি সনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজনকে সনাক্ত করা গেছে। এটি একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ। এতে দেশী ও বিদেশী চক্রের লোকজন জড়িত রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করা হয়েছে। দেশী চক্রে প্রভাবশালী মহল জড়িত। তাদের নাম প্রকাশ করা সহজ কাজ নয়। জীবনের ঝুঁকি আছে। আমরা প্রায় নিশ্চিত কারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত।

তিনটি তদন্ত দলই নিজেদের পাওয়া তথ্য নিয়ে বৈঠক করেছে। তথ্য উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১টি কম্পিউটার ও ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা স্থানান্তরের কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটারের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে। আরও কিছু তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা করছে তদন্ত দল।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার মার্কিন ডলার হ্যাকিং করে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল এমন দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৭ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার হ্যাকাররা নিতে পেরেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সাইবার আক্রমণে ৩৫টি ভুয়া পরিশোধ নির্দেশের ৯৫ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের মধ্যে ৩০টি নির্দেশের ৮৫ কোটি ডলার বেহাত হওয়া শুরুতেই প্রতিহত করা গেছে। অবশিষ্ট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে দুই কোটি ডলার এরই মধ্যে ফেরত আনা গেছে। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার (প্রায় ৬৩৫ কোটি টাকা) ফেরত আনার প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

এর মধ্যে মাত্র ৫৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ উদ্ধার করতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন সচিব আসলাম আলম।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই আর্থিক খাতে পরিবর্তন আনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা ডেপুটি গভর্নর-১ আবুল কাসেম ও ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা-৪ কে চাকুরিচ্যুত করা হয়। এর পরেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলমকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।