মসজিদকে মদের দোকান-হোটেল বানাচ্ছে ইহুদিবাদী ইসরাইল

হোটেল বানাচ্ছে ইহুদিবাদী ইসরাইল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিনে নিযুক্ত অটোমান শাসক জহির আল ওমার আল জায়দানি ১৭৪৩ সালে খান স্কয়ারে এটি তৈরি করেন। টাইবেরিয়াসের বিখ্যাত এ স্থাপনাটি জায়দানি মসজিদ নামেও পরিচিত। মিশরের মামলুক শাসন ব্যবস্থার ঐতিহ্যবাহী কারুকার্যে তৈরি বিশাল গম্বুজ এবং মিনারের কারণে প্রসিদ্ধ ছিল ওমার মসজিদ।

১৯৪৮ সালে আমূল পাল্টে যায় ফিলিস্তিনিদের সবকিছু। ওই বছরের ১৪ মে বিশ্ব ইহুদি সংগঠনের প্রধান ডেভিড বেন গুরিয়ন ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে। দিনটিকে ইসরাইলিরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে। ১৫ মে দিনটিকে ’নাকবা’ বা ’মহাবিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে ফিলিস্তিনিরা।

ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার পরই ফিলিস্তিনিদের তাড়াতে নৃশংতা আরো বাড়িয়ে দেয় ইহুদিরা। যাতে স্পষ্টভাবে সমর্থন দেয় ব্রিটেনসহ পশ্চিমারা। ওই সময় ফিলিস্তিনের অর্ধেক বাসিন্দা জীবন বাঁচাতে নিজেরদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

ফিলিস্তিনের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের মতো টাইবেরিয়াসের বাসিন্দারাও সেসময় সিরিয়া, লেবাননে আশ্রয় নেন। কমিটি ফর আরব সিটিজেন অব ইসরাইলের মুখপাত্র কামাল খতিব তুর্কি গণমাধ্যম আনাদোলুকে জানান, জায়াদানি পরিবারও সেসময় পার্শ্ববর্তী নাজারেথ শহরে চলে যায়।

ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে তাদের ঘরবাড়ি, সহায় সম্পত্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় ইহুদি দখলদাররা। যাতে অন্তর্ভূক্ত হয় ওমারি’র মতো বহু ঐতিহ্যবাহী মসজিদ।

কামাল বলেন, নাকবার পরে জায়দানি পরিবার ওমারি মসজিদকে সংস্কার করে আবারো নামাজ আদায়ের জন্য উপযুক্ত করতে ইসরাইল কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন জানায়।

‘টাইবেরিয়াস কর্তৃপক্ষ তাদের সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। জানায়, তারা স্থাপনাটি সংস্কার করে পুনরায় চালু করবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’ বলেন কামাল। ‘সংস্কার বা খুলে দেয়ার কথা বলা হলেও ওমারি মসজিদে এখনো নামাজ নিষিদ্ধ। প্রবেশ করতে দেয়া হয় না কাউকে।’

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০টি মসজিদ ইসরাইলিরা ধংস করে দিয়েছে বা সেগুলোতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। আরো ১৭টি মসজিদকে মদের দোকান, হোটেল, জাদুঘর, সিনেমা হলে পরিণত করা হয়েছে।

এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য, উত্তরাঞ্চলীয় সাফেদ শহরের আল আহমার মসজিদকে কনসার্ট হলে রূপান্তর করা হয়েছে। কৈসরিয়ার আল জাদিদ মসজিদকে বানানো হয়েছে মদের দোকান।

কামাল বলেন, ’নাকবার আগে যে মসজিদগুলো মুসল্লিতে পরিপূর্ণ থাকতো সেগুলোতে এখন কাউকে প্রবেশই করতে দেয়া হয় না। নিজেদের দখলে নিয়ে মসজিদগুলোকে সিনেগাগা, মদের দোকান, জাদুঘর, ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ বানানো হচ্ছে।’

‘মুসলমানদের বিক্ষোভ সত্ত্বেও জাফায় আল ইসাফ কবরস্থান ধ্বংস করে দেয় ইসরাইল। ইসরাইলি নীতিতে মুসলমাদের অনুভূতিকে কখনোই মূল্যায়ন করা হয় না।’ বলেন কামাল।

ফিলিস্তিনিরা জীবন বাঁচাতে পালাতে বাধ্য হলে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে আইন পাস করে ইসরাইল। ‘ইসরাইলি পার্লামেন্টে পাস করা বাজেয়াপ্ত আইনে অনুপস্থিত আরব মুসলমানদের বাড়িঘর, সম্পত্তি দখলে নেয় ইহুদিবাদীরা।’ বলেন কামাল।

মসজিদকে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসরাইল। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দেশটিতে ৪শ’ মসজিদ রয়েছে। গেলো ২৫ বছরে সেখানে মুসল্লির সংখ্যা ৫ গুণ বেড়েছে বলেও দাবি করা হয়।

ইসরাইলে এমন দাবি প্রত্যখ্যান করে কামাল বলেন, ইসরাইল সরকার তাদের ইতিহাসে একটি মসজিদও তৈরি করেনি।

১৯১৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্যই ছিল ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এসময় আরব মুসলিমদের দখলে ছিল ফিলিস্তিনের ৯৭ শতাংশ ভূমি। ইহুদিদের দখলে ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ব্রিটিশ সহয়তায় তখন ফিলিস্তিনের ভূমিতে চলতে থাকে ইউরোপ থেকে এনে ইহুদি পুনর্বাসন।

১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশে। তখন আরবদের ভূমির পরিমাণ ছিল ৯৫ শতাংশ। ইহুদিদের মাত্র ৫ শতাংশ। ১৯৪৬ সালে ইহুদিদের দখলে যাওয়া ফিলিস্তিনের ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ শতাংশে।

১৯৪৭ সালে অবৈধভাবে ফিলিস্তিনের ভূমির ৫৫ শতাংশ ইহুদিদের দেয়ার ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। তখনও ফিলিস্তিনিদের দখলে ৯৪ শতাংশ ভূমি। জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশই ফিলিস্তিনি। সঙ্গত কারণেই জাতিসংঘের একতরফা, অবৈধ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ফিলিস্তিনিরা।

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশদের সহায়তায় ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদিরা। নির্মম নির্যাতন শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উপর। ইহুদিবাদী সেনাবাহিনী সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে নৃশংভাবে বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করে। গুড়িয়ে দেয়া হয় ফিলিস্তিনিদের ৫৩০টি গ্রাম। দখলে নেয় ঐতিহ্যবাহী ভূমির ৭৮ শতাংশ। বাকি ২২ শতাংশ ভূমি গাজা এবং পশ্চিম তীরে ভাগ হয়।

১৯৪৯ জাতিসংঘ ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। উপেক্ষিত থাকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অধিকার।

এখানেই থেমে থাকেনি দখলদার ইহুদিরা। ১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা দখলের মাধ্যমে পুরো ফিলিস্তিন জবরদখল করে ইসরাইল। যা আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জোরপূর্বক দখলের ঘটনা।

১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনের সঙ্গে অসলো চুক্তি করেন। যার মূল বিষয় ছিল ১৯৬৭ সালের পূর্বে ফিলিস্তিনিদের দখলে থাকা ভূমিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আলোচনা।

১৯৯৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে পশ্চিম তীর এবং গাজার আংশিক নিয়ন্ত্রণ পায় ফিলিস্তিনিরা। নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ এবং যে কোনো সময় সেখানে অভিযান চালানোর ক্ষমতা থেকে যায় ইসরাইলের হাতে।

এখনো পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। অব্যাহত রয়েছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর অবরোধ, অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, বর্বরতা।

সূত্র: মিডলইস্ট মনিটর