বিপদ বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে

সাস্থ ডেস্ক: জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বিপদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। গরু, ছাগল ও মুরগির গোস্ত এবং মাছ; খাদ্যের তিন উৎস থেকেই মানুষ নিজের অজান্তে শরীরে গ্রহণ করছে অ্যান্টিবায়োটিক। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত না খাওয়া এবং চিকিৎসকের অজান্তে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন রোগীর দেহের ব্যাকটেরিয়াকে রেজিস্ট্যান্স করে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে অবিলম্বে রোগীর দেহে প্রয়োজনীয়তা থাকলেই কেবল অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে। তা না হলে রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ না করার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না।

বুধবার (২৪ এপ্রিল) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে ৪০০ লোক মারা গেছেন। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিতে বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন করছেন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই।

২০১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড অ্যান্ড বেসিক মেডিক্যাল রিসার্চে প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য অনুসারে, যশোর সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর উপজেলার চিকিৎসকরা নারী রোগীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন। ০-১৫ বছর বয়সীদের ৩৩ ভাগকে, ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের ২৩ ভাগকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ইনফেকশনের জন্য ৪২ ভাগকে, জ্বর ও ঠান্ডার জন্য ৩৪ ভাগ, ডায়রিয়ার জন্য ১৪ ভাগ, গনোরিয়ার জন্য ৩ ভাগ এবং অন্যান্য রোগের জন্য ৫ ভাগকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া সেফালোসপোরিন ৩১ ভাগ, সিআই ২৫ ভাগ, কুইনোলোনস ১৬ ভাগ, পেনিসিলিন ৭ ভাগ, মেট্রোনিডাজল ৬ ভাগ।

ওই গবেষণায় আরও দেখা যায়, একটি প্রেসক্রিপশনে এক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে ৭৪ ভাগ রোগীকে। একাধিক ধরনের দেওয়া হয়েছে ২৫ ভাগ প্রেসক্রিপশনে। ৬৬ ভাগ প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরো তথ্য ছিল। ৫৭ ভাগে এর খাওয়ার নিয়ম লেখা ছিল এবং ৮৩ ভাগ প্রেসক্রিপশনে কোনও পরীক্ষা ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড স্যোশাল মেডিসিন (নিপসম)-এর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আকরাম হোসেন বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স-এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে অপব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে কেউ নিজে নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে পারেন বা চিকিৎসক না বুঝে তাকে দিতে পারেন। আরও বেশকিছু কারণ আছে যেগুলো সাধারণের আওতার বাইরে। অ্যান্টিবায়োটিক এখন মানুষ ছাড়াও পশু খাদ্যে এবং মাছে ব্যবহৃত হয়। অ্যান্টিবায়োটিক যেখানেই ব্যবহার হোক না কেন সেটা আবার মাটিতে যায়। এখন ড্রেনের পানিতেও কঠিন কঠিন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। মাছ ও বিভিন্ন খাদ্যে এটি ব্যবহার হয়, আর সেগুলো মানুষও খায়।

অধ্যাপক আকরাম বলেন, কোম্পানিগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রি বাড়িয়ে মুনাফার চেষ্টা করে। কোম্পানির লোকজন চিকিৎসকদের বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক তথ্য দেয়, এতে করে চিকিৎসকরা রোগীকে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক দেন। আর এখন যেহেতু মানসম্পন্ন চিকিৎসক ছাড়াও অনেক কোয়াক (হাতুড়ে) চিকিৎসক আছেন। অ্যান্টিবায়োটিক সাতদিন খেলে রেজিস্ট্যান্স হয় না। কিন্তু কোয়াকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন ফলো করে অ্যান্টিবায়োটিক দিলেও দুই দিন খাওয়ানোর পর জ্বর ভাল হয়ে গেলে তা বন্ধ করে দেন। এর ফলে সঙ্গে সঙ্গে রোগীর শরীর রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, যে কেউ ফার্মেসিতে গিয়ে যেকোনও অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পারেন। অথচ অনেক রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনও প্রয়োজন নেই। যেমন- গলা ব্যথার শতকরা নব্বই ভাগ ভাইরাল। রোগী হয়ত তিনদিন খাওয়ার পর গলা ব্যথা কমে গেলো। এই তিন দিনে ভাল যে ব্যাকটেরিয়া ছিল সেগুলো মারা গেলো। আর খারাপ ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হলো।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক দুই তিন দিনের বেশি দেওয়া হয় না। তিনদিন খেয়ে অনেকে ভালো হয়ে গেলে পরের ওষুধ কেউ নিতে আসে না। অ্যান্টিবায়োটিক শুধু চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দেওয়ার কথা থাকলেও কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডাররাও (সিএইচসিপি) সাত ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। এটার কারণেও ক্ষতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সরোধে বহুমাত্রিক উদ্যোগ প্রয়োজন। পশুখাদ্যে যেনও কেউ অ্যান্টিবায়োটিক না দেয় তার জন্য আইন করতে হবে। রোগীর নির্দিষ্ট রোগের জন্য কোন অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে চিকিৎসকের তা পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। এতে রোগী সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক পাবেন। আবার, যদি আমরা সারাবছরের তথ্য রাখি তাহলে চিকিৎসককে জানাতে পারবেন কোন অ্যান্টিবায়োটিকটা রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে। এছাড়া একটা ওষুধ অনেকদিন ব্যবহার না হলে তার সেনসিটিভিটি ফিরে আসে। কোন অ্যান্টিবায়োটিক রিজার্ভ রাখব, কোনটা আবার ফিরে আসছে- সেটার তথ্য রাখতে পারলে রোগীর উপকারের পাশাপাশি পুরো কমিউনিটির উপকার হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক চেইনের একটা অংশ হয়ে গেছে। গবাদিপশুর মধ্যে অথবা খাদ্যশস্যের মধ্যে যদি অ্যান্টিবায়োটিক থাকে তাহলে সেটা মানুষের শরীরে যাবে। আমরা ‘ওয়ান হেলথ’ নিয়ে কাজ করছি। আমরা পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নে কাজ করছি। এটার জন্য আমাদের নজরদারি প্রয়োজন। কোন অ্যান্টিবায়োটিক কোথায় কাজ করছে, এটা আমাদের জানা দরকার। আমরা এই জন্য ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক করছি। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে যেসব রোগী আসবেন তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। ঢাকায় রেফারেন্স ল্যাবরেটরি করা হবে। ঠিক একইভাবে অ্যানিম্যাল হেলথ-এর একটা ল্যাবরেটরি আছে। তাদের ল্যাবরেটরিও এই বিষয়গুলো দেখবে। পাশাপাশি চিকিৎসকদের আমরা সচেতন করে তুলব যেনও তারা বিনা যুক্তিতে কোনও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করে। দেশে ইতোমধ্যেই একটি আইন পাস হয়েছে। এই আইনে কোনও ফার্মেসি বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে পারবে না।”

ডা. আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ‘ফ্লেমিং ফান্ড নামে ইংল্যান্ডের একটি সংস্থা আসছে। তারা আমাদের এই বিষয়টি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। আমরা চেষ্টা করছি জনগণ যেন সচেতন হন, তারা যেনও বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক না খান। আবার, ওষুধের দোকানও যেন যার তার কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না করে। জনগণকে বুঝতে হবে, ইচ্ছে মতো অ্যান্টিবায়োটিক খেলে শেষ পর্যন্ত নিজেরই ক্ষতি।