বিনিয়োগ বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কমবে বেকারত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমানে মফস্বল থেকে উঠে আসা  স্নাতক শ্রেণী পড়–য়ারা শিক্ষাজীবন থেকেই চাকরির সন্ধান করছে। বিভিন্ন চাকরিতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও দেখা গেছে মৌখিক পরীক্ষায় সে পিছিয়ে পড়ছে। শত চেষ্টা করলেও চাকরি মিলছেনা তাদের। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে তারা বেকারে পরিণত হচ্ছে। আবার বাড়িতে কোনো কাজও করতে পারছে না। ফলে অলস সময় কাটছে উচ্চশিক্ষিত এই বেকারদের।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদ- অনুযায়ী সক্ষম জনগোষ্ঠী যারা সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টাও কাজ করেন না, তাদের বেকার বলা হয়। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সি কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ। সুতরাং এক বছরে বেকার বেড়েছে ৮০ হাজার। জাতীয় বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। মোট বেকারত্বের ১১ দশমিক ২ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত।

বলা হচ্ছে, প্রতি বছর ২০ লাখের মতো মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে। সে তুলনায় কর্মসংস্থান কম হয়েছে। আবার যে পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বা হয়েছে, তার বেশিরভাগই নির্দিষ্ট এলাকায়Ñ ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ইত্যাদি বড় বড় শহরকেন্দ্রিক। দেশে বেকারত্বের গড় হার ৪ দশমিক ২ শতাংশে স্থির থাকলেও আঞ্চলিক বেকারত্বের ব্যাপক তারতম্য আছে বলে মনে করা যায়।

শিক্ষার যে সুযোগ, তা এখনও সবার জন্য সমান হয়নি। উচ্চশিক্ষা এখনও ব্যয়বহুল। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কম হওয়ায় অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে। শিক্ষার খরচ বেশি হওয়ায় একজন সাধারণ কৃষকের তার সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারছেন না। ভর্তি করতে পারলেও পাবলিক কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে জীবনের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বের হয়ে আসছে, কাঙ্খিত মানের কর্মের জোগান না হওয়ায় শেষে তারা অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা আছে, এমন লোকের মধ্যে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, এমন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্ব ১১ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ যিনি যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছেন, তার বেকারত্বের সম্ভাবনা তত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার আমরা শ্রমশক্তি ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারছেনা। মেধা বিকাশের বা প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করতে না পারলে ‘ব্রেন ড্রেইন’ এর সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। মেধার সংকট এক সময় তীব্র হতে পারে।

তাদের মতে, গত অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বলা হচ্ছে, এ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত বছরকে অতিক্রম করে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশ করতে পারবে। তবে দেশের অভ্যন্তরে সুষম উন্নয়ন ছাড়া কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। সুষম উন্নয়নের জন্য শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম বা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় স্থাপন না করে দেশের অন্যান্য স্থানেও শিল্পকারখানা স্থাপনের কথা ভাবতে হবে। শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ হলে যখন কোনো একটি এলাকায় বড় শিল্প ও কলকারখানা গড়ে উঠবে, তখন ওই শিল্প-কারখানাকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট অনেক শিল্পকারখানা বা ব্যবসা-বাডুজ্যের প্রসার ঘটবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা হতে থাকবে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারের খাস জমি আছে। এই জমিগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা করে শিল্পায়ন করা গেলে শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ এমনিতেই ঘটবে। শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারলে শ্রমিকের দক্ষতা যেমন বাড়বে, তেমনি শ্রমের মাইগ্রেশন কমে যাবে। ফলে বেকারত্বের যে আঞ্চলিক বৈষম্য বর্তমানে বিরাজ করছে, তা কমে যাবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানে দেশের এক অঞ্চল উন্নয়নের অনেক সুবিধা ভোগ করলেও অন্য অঞ্চল উন্নয়নের মূল ধারা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা তার আশেপাশের শ্রমিক যে দরে তাদের শ্রম বাজারে বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছেন, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী বা কুষ্টিয়ার শ্রমিক সে দরে শ্রম বিক্রি করতে পারছেন না। ঢাকা বা তার আশপাশের কৃষক ফসল উৎপাদন করে যে মূল্য পাচ্ছেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক একই ফসল উৎপাদন করে সে পরিমাণ মূল্য পাচ্ছেন না।

যদিও এই দুই প্রান্তের কৃষকের শ্রমের মূল্য ছাড়া উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের মূল্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকেনি। তারা একই দরে ইউরিয়া, পটাশ বা কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার করে উৎপাদন করেছেন। স্থানীয়ভাবে ভোক্তা কম হওয়ায় বা প্রধান প্রধান ভোক্তা বাজার দূরবর্তী হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তারা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য তুলনামূলক কম পাচ্ছেন। ফলে দেশের অভ্যন্তরে আয়বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। যে অঞ্চলের মানুষের আয় কম হচ্ছে, তারা আর্থিক কারণে প্রতিযোগিতামূলক কর্মকান্ডে, বাজারে, শিক্ষাব্যবস্থায়, প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকছে। নীলফামারী বা পঞ্চগড় এলাকায় অবস্থিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা একজন ছাত্র আর ওই এলাকার একজন ছাত্র, যিনি কিনা ঢাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এই দুজনের মধ্যে একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়া স্বাভাবিক।

দেখা যাবে, সাধারণত যে ছাত্র ঢাকা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে, সে পরবর্তী জীবনে বেশি দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। উন্নয়ন যখন সুষম হবে, তখন এই পার্থক্য কমে যাবে, বেকারত্ব কমে যাবে। আমাদের বিপুল জনসংখ্যাকে, বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র তৈরি করে যদি দক্ষ করে তোলা যায়, তবে উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে, তা অর্জন করা যেতেই পারে। যে দেশের সিংহভাগ মানুষ কর্মক্ষম, যে দেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল অংশ তরুণ, সে দেশ কখনোই পেছনে থাকতে পারে না।