প্রসঙ্গ: ঢাকার যানজট; ‘মেট্রোরেল বা ফ্লাইওভার নয়; ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণই সমাধান- একটি বিশ্লেষণ’

বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষা ঢাকা শহরটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল শহরগুলোর অন্যতম।  এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যকেন্দ্র।  কিন্তু এই ঢাকা শহরে যারা থাকেন তারা জানেন এখানে যানজটের তীব্রতা কতটা ভয়াবহ এবং এর যন্ত্রণাটা কেমন।  এই শহরের যানজটের কাছে সময়ের যেন কোনো মূল্যই নেই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতছাড়া হয়ে যায় অসহ্য ট্রাফিক জ্যামের ভীড়ে।  যথা সময়ে অফিসে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না।  অফিসের বস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের বকাঝকাও শুনতে হয় এজন্য।  উনারা বুঝতে চান না যে, রাস্তার উপচেপড়া গাড়ি ও মানুষের চাপাচাপিতে শহরটা দিনদিন কেমন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।! রাস্তার এ মাথা থেকে ওমাথা, এদিক থেকে সেদিক, সবদিকেই শুধু গাড়ি আর গাড়ি।  ধীর গতি ও দ্রুত গতির গাড়ির আলাদা কোনো লেন নেই।  যেখানে সেখানে পরিকল্পনাবিহীন দালান-কোঠা, শপিং কমপ্লেক্স ও বাসা-বাড়ি তো আছেই।  যখন জ্যামে পড়ে সিগনালে পড়েই থাকি, হতাশ হয়ে তখন কল্পনায় ভাবি, যদি এমন একটা এয়ারযান আবিষ্কার করতে পারতাম, যেটাতে করে উড়ে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাওয়া যেত !! তাহলে কত সময়ই না বেঁচে যেত, কত কাজই না করতে পারতাম!! ছোটোবেলায় ‘সময়ের মূল্য’ নামে একটি রচনা পড়েছিলাম।  রচনাটি পরীক্ষায় কমনও আসতো বারবার।  কিন্তু ঢাকা শহরে ছোট্টবেলার সেই রচনাটি যেন মূল্যহীন, অসহায়! যানজটের এই শহরে আজ ১০ মিনিটের রাস্তা পার হতে এক থেকে দুই ঘণ্টা লাগে! ২০০৯ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ বিভাগ ঢাকার যানজট-সংক্রান্ত এক গবেষণায় উল্লেখ করেছিল, ঢাকা শহরে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় চলাচলকারী যানবাহন গড়ে ৭ দশমিক ৫ ঘণ্টা থেমে থাকে।  মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) গবেষণা অনুযায়ী, শুধু যানজটের কারণে আট বছর আগে নগরবাসীর প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হতো।  এখন এর পরিমাণ আরও অনেক বেড়েছে।
ঢাকার অসহ্য এই যানজট শহরের প্রধান সমস্যা।  এর সমাধানকল্পে বছরের পর বছর পরিকল্পনা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।  হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে, কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। দিনদিন বরং যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।  অনেকের মনে প্রশ্ন দানা বাঁধছে, যানজট নিরসনের কি কোনো প্রতিকার নেই? ঢাকার যানজট কি শেষ হবে না কোনোদিনও?

 

সমস্যা বিশ্লেষণে গভীরে না গেলে এবং তার যথাযথ বাস্তব, যৌক্তিক ও জনকল্যাণমুখী সমাধানপ্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে না পারলে যে ঢাকা শহর বেশিদিন টিকবে না এবং কয়েক বছরের মধ্যেই যে ঢাকা বসবাসের জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য শহরে পরিণত হবে এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।  যারা ঢাকায় থাকেন তারা কেবল চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশুনা প্রভৃতির জন্য বাধ্য হয়েই থাকেন।  তাছাড়া ঢাকা শিক্ষা-সংস্কৃতি, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও আপন প্রতিভার বিকাশ ও চর্চার কেন্দ্র-বিন্দু।  এজন্যই মানুষ গ্রামের সহজ-সরল ও নিরীহ আবহ ছেড়ে ইট-বালুর এই শহরে পাড়ি জমান।  এর প্রভাব হিসেবে প্রতিদিন নতুন করে ঢাকায় যুক্ত হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন মানুষ।  দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে।

 

ঢাকা শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস।  যার প্রতি কিলোমিটারে বসবাস প্রায় ৪৫ হাজার লোকের।  অত্যাধিক মানুষের চাপে এখানে অপরাধ, প্রতারণা, মাদকসহ নানা অপকর্ম সংঘটিত হয়।  শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, বিশুদ্ধ পানির অভাব, ধুলাবালির ছড়াছড়ি, বাসস্থানের সঙ্কটসহ আরো নানা ধরনের সমস্যা এখানে বিরাজমান এবং এগুলো জানা সত্ত্বেও জনসাধারণ ঢাকাকেই বেছে নিচ্ছে, ভীড় জমাচ্ছে এখানেই।  কিন্তু কেন?

মূলত এর মূল কারণই হচ্ছে জীবন ও জীবীকার তাগিদ।  কল-কারখানা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সবই তো ঢাকায়।  তাছাড়া নামী-দামী মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র এই মেগাসিটিতেই অবস্থিত।  স্বপ্নপূরণের অদ্বিতীয় শহর এটা।  সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ ও প্রকাশ করার বিকল্পহীন শহরও এটি-ই।  তাই ঢাকার তুলনায় অন্যান্য শহর ও জেলা শহরগুলোর আকর্ষণ অনেক কম।  জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপও সেখানে নেই।  ঢাকার জনসংখ্যার আধিক্য দেখে অনেকে দেশের বিপুল সম্ভাবনাময় জনসমষ্টিকে অভিসম্পাতও করে থাকে। আসলে ২০ কোটি জনগণ বাংলাদেশের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, বোঝাও নয়, বরং বড় সম্ভাবনা।  তাছাড়া আমাদের জনসংখ্যার বড় একটা অংশই তরুণ।  লক্ষনীয় যে, মাঝেমধ্যে সম্ভাবনাও সমস্যায় পরিণত হয়, যখন সম্ভাবনাগুলোর যথাযথ ব্যবহার করা না হয় বা এদেরকে কাজে লাগানো না যায়।  ২০ কোটি মানুষকে যদি সারা দেশে ঢেলে সাজানো যেত, তবে পুরো বাংলাদেশের চেহারাই বদলে যেতো।
ঢাকার জনসংখ্যা যেমন ভারসাম্যহীন, তদ্রুপ সুযোগ-সুবিধাও ভারসাম্যপূর্ণ নয়।  সকল সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রবিন্দু এই ঢাকা।  এই সুযোগ ছুঁতেই এখানে অত্যাধিক জনস্রোত এবং এটাই যানজটের প্রধান কারণ।  আর এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণের অঙ্কটাও অনেক বড়।  বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই)-এর এক হিসাবে, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ডলার বা প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
এবার আসুন সমস্যার সমাধান খুঁজি:

স্মরণীয় যে, ঢাকা শহরের জায়গা বা আয়তন কিন্তু বৃদ্ধি পাচ্ছে না, (যদিও আশপাশের কিছু এলাকা ঢাকার মধ্যে যুক্ত হচ্ছে)।  কেবল জনসংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে।  আর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানে শহরের খালি জায়গাগুলো দিনদিন ক্রমেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে।  এই কারণে ঢাকা শহরের যানজট বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।  তার মানে আমাদের এমন একটা সমাধান খুঁজতে হবে যাতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যার চাপ না বেড়ে বরং কমতে থাকে। তবেই কেবল যানজট থেকে নিস্তার পাবে ঢাকাবাসী, বসবাসযোগ্য শহরে পরিণত হবে ঢাকা, ঢাকার বাতাস ফিরে পাবে তার হারানো সজীবতা ও নির্মলতা।  বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যে সকল পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে তার পুরোটাই মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভার কেন্দ্রিক।  সরকারের পরিকল্পক ও আমলাদের ধারণা, এতেই যানজট কমে যাবে।  দেশীবিদেশী বিভিন্ন পরিকল্পকরা এমন কথা বলেই না কি তাদের আশ্বস্ত করেছেন। ঢাকাবাসীও বুঝে না বুঝে এমন আসায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছেন।  কিন্তু মেট্রো বা ফ্লাইওভার কি আদৌ যানজট কমাতে সক্ষম? প্রকৃতপক্ষে মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভার দিয়ে ঢাকার বাহ্যিক চেহারা পাল্টানো গেলেও যানজট মোটেও কমানো যাবে না।  কারণ ঢাকামুখী জনস্রোত থামানো না গেলে পুরো শহর যদি ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেলে পূর্ণ করে ফেলা হয়, তবুও যানজট কমবে না; বরং বাড়তেই থাকবে।

 

 

 

প্রথমেই উল্লেখ করেছি- যানজট কমাতে হলে ঢাকার জনসংখ্যার আধিক্য বা চাপকে কমাতে হবে।  ঢাকামুখী জনস্রোতকে নিজ জেলা বা আশপাশের শহরমুখী করে দিতে হবে।  এটা করা যাবে যদি ঢাকার সুযোগ-সুবিধাগুলো অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে দেয়া যায়।  শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরী, ডিজিটালাইজেশন, শিল্প-সংস্কৃতি, উন্নত সাস্থ্যসেবা প্রভৃতির সুযোগ-সুবিধা শুধু ঢাকায় না রেখে সারা দেশব্যাপি এর ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টনই ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমাতে পারে।  জোর করে তো আর কাউকে ঢাকামূখী হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না।  দেশের অন্যান্য বড় শহর ও জেলা শহরগুলোতে কর্মমুখী পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে ঢাকামুখী জনস্রোত রোধ করা সম্ভব হবে এবং তারা অন্যান্য শহরমুখী হয়ে যাবে।  টঙ্গি, গাজিপুর, আশুলিয়া, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।  সেখানে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও বিভিন্ন কলকারখানা হওয়ার ফলে সারা দেশের প্রচুর শ্রমিক ঐ জেলাগুলোতে কাজের জন্য ছুটে চলছেন।  তাছাড়া কর্মের সুযোগ আছে বলেই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আমরা বিদেশে পাড়ি জমাই।  দেশের প্রায় এক কোটি কর্মজীবী মানুষ আজ প্রবাসী তথা বিদেশে কাজ করে দেশে টাকা পাঠান।  দেশের বাইরে কাজের সুযোগ না থাকলে তাদের বড় একটা অংশ ঢাকায় ভীড় জমাতেন। যানজটও আরো বৃদ্ধি পেতো।  অতএব বুঝা গেলো- যেখানেই কাজের সুযোগ থাকে সেখানেই মানুষ ছুটে চলে। তাই ঢাকার বাইরের অন্যান্য শহরগুলোয় পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করতে হবে অর্থাৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ব্যাংকিং সেবা, উন্নত চিকিৎসা সেবা, ডিজিটাল সেবা প্রভৃতি নিশ্চিত করা গেলে ঢাকার জনসংখ্যার চাপ ক্রমেই কমে যাবে।  নিজ জেলায় কাজের বা পড়াশুনার সুযোগ থাকলে কেউ আর তখন ঢাকামুখী হতে চাইবে না।  নিজের জেলায়ই থেকে যাবে।  অন্যান্য শহর ও জেলা শহরগুলোর উন্নয়ন ঘটবে।  সেখানকার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। এভাবে পুরো দেশের উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য রক্ষা পাবে।  দেশের প্রতিটি জেলা-ই তখন হয়ে উঠবে উন্নয়ন ও জনকল্যাণমুখী নগরী।

উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা যায়।  দেশের বাইরে যেখানেই মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ভীড় জমিয়েছে।  বিশেষ করে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয় বেশী।  ছোট্ট একটা উদাহরণ দেয়া যাক- শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে অবস্থিত জেড এইচ শিকদার ইউনিভার্সিটি।  মাত্র ৫/৬ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি এই ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের।  যদি ওখানে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে না উঠতো তবে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশই ঢাকার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভীড় জমাতো।  এতে তারা ঢাকায় আরো যানজটের কারণ হয়ে উঠতো।  আবার বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজ জেলায় হওয়ায় অনেকেই উচ্চ শিক্ষার সুযোগও পাচ্ছে।  বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত না হলে হয়তো অনেকে উচ্চ শিক্ষা করতে ঢাকায় আসতেও পারতো না। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু ঢাকামুখী শিক্ষার্থীদের শরীয়তপুরমুখী-ই করেছে তা নয় বরং নিজ জেলায় উচ্চ শিক্ষার দ্বারও উন্মোচন করেছে অর্থাৎ একটি জেলাকে আলোকিত করতে ভুমিকা রাখছে।  ঢাকার পরিবর্তে এভাবে অন্যান্য জেলায়ও যদি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি/মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠতো তবে জেলাগুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ঢাকায় এসে ভীড়ও করতো না এবং ঢাকার যানজটের কারণও হতো না।

প্রাপ্ততথ্যমতে, ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যয় হবে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।  এরমধ্যে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা দিবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।  বাকিটা বাংলাদেশ সরকার বহন করবে।  অন্যান্য ফ্লাইওভার নির্মাণেও ব্যয় হচ্ছে শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা।  যেমন- গুলিস্থান-যাত্রাবাড়ি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারটি নির্মানে ব্যয় হয় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।  মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২১৮ কোটি টাকা।  এতো হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভার। কিন্তু এটা কি দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান? বিশেষজ্ঞদের মতে, “মেট্রোরেল বা ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে বিশেষ কোনো ভুমিকা রাখে না। তাদের মতে, উন্নত বিশ্বে অকার্যকর হিসেবে বাতিল হওয়া ফ্লাইওভার পরিকল্পনাটি বাংলাদেশে বিলাসিতা বৈ কিছুই নয়।  যানজট না কমিয়ে বৈদেশিক দেনা বাড়াচ্ছে এসব প্রকল্প।”

তাছাড়া ফ্লাইওভার নির্মানকালে বছরের পর বছর সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।  যারা কিছুদিন আগেও ফ্লাইওভার নির্মানকালে অর্থাৎ২০১৩-২০১৭ পর্যন্ত মগবাজার, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ, রাজারবাগ যাওয়া আসা করেছেন, তারা বিষয়টা ভালকরেই জানেন।  সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি-কাঁদা লেগে থাকে।  আবার বৃষ্টি না হলে ধুলো-বালির কারণে চলাচল করা খুবই কষ্টকর হয়ে যায়।  আরো উল্লেখ্য, ফ্লাইওভারের অতিরিক্ত টোলের কারনে অধিকাংশ গাড়িই ফ্লাইওভার ব্যবহার করে না।  ফ্লাইওভারের কারণে অনেক রাস্তার একপাশ ব্লক হয়ে যায়।  আর এর নিচে সবসময় ভাঙ্গা, উচু-নিচু, ধুলা-ময়লা জমে থাকে।  মেট্রোরেলের কথা আর কী-ই বা বলবো! যতটা জানি, পৃথিবীর সকল দেশ-ই বড় অঙ্কের ভর্তুকী দিয়ে মেট্রো ব্যয় নির্বাহ করে।  কোনো দেশেই মেট্রো কোনোদিন লাভের মুখ দেখেনি।  তাহলে জেনেশুনে কেন আমরা এই লস প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছি!! আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ কতদিন ভর্তুকি দিবে এই মেট্রোর পেছনে!!

সরকার চাইলে মেট্রোরেল বা ফ্লাইওভার নির্মানের পরিবর্তে এর অর্থ দিয়েই ঢাকার বাইরের অন্যান্য শহরহুলোকে ঢেলে সাজাতে পারেন, অর্থাৎ ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারেন।  কারন, ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ-ই যানজট নিরসনের একমাত্র সমাধান।  যদি এটা করা যায়, তবেই ঢাকা শহরের জনসংখ্যার চাপ কমা শুরু হবে।  যানজটের অভিশাপ থেকেও আমরা রেহাই পাব।  যানজটের কারণে লোকসান হিসেবে বছরে ক্ষতি হওয়া ৯৮ হাজার কোটি টাকাও আমাদের গুনতে হবে না।  বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য ও অনুপোযুক্ত শহরের তালিকা থেকেও মুছে যাবে ঢাকার নাম।  ঢাকা হয়ে উঠবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম স্বপ্নের নগরী।

 

লেখক: মুহম্মদ জিয়াউল হক আখন্দ, ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট ও সমাজকর্মী