পোল্ট্রি ও ডেইরি ফার্মে বিপর্যয়, খামারিদের মাথায় হাত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অঘোষিত লকডাউনের প্রকোপে গ্রামীণ অর্থনীতে যে আঘাত এসেছে তার চরম শিকার হচ্ছে হাজার হাজার পোল্ট্রি ও ডেইরি ফার্ম। আমিষ বা প্রোটিন জাতীয় খাদ্য- মাংস, ডিম ও দুধের যোগানদাতা এ শিল্প এখন দারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন।

টানা লকডউন ও পরিবহন সংকটের কারণে খামারিদের উৎপন্ন মুরগির মাংস, ডিম আর দুধের দাম পড়ে গেছে। অপরদিকে, আমদানিকৃত পশুখাদ্য, মুরগির খাবার ও ওষুধপত্র সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় খামারিদের মাথায় হাত। সামনে আরো ভয়াবহ সময়ের কথা ভেবে তাদের দিন কাটছে চরম উদ্বেগে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইনডাস্ট্রিজ সেন্টাল কাউনসিল (বিপিআইসিসি) জানিয়েছে, দেশে প্রতি সপ্তাহে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মুরগীর বাচ্চা উৎপন্ন হয়। গড়ে প্রতিটি বাচ্চা উৎপাদন করতে ১৫ থেকে ২০ টাকা খরচা হয়। করোনা সংকটের কারণে যে সামান্য সংখ্যক বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে তাতে প্রতি বাচ্চার জন্য দাম জুটছে ২ থেকে ৪ টাকা। এখন শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ বাচ্চাই বিক্রি হচ্ছে না। অনেকের বাচ্চা হ্যাচারিতে মারা যাচ্ছে। সপ্তাহে কমপক্ষে এক কোটি মুরগির বাচ্চা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হচ্ছে।

জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপাতি আনোয়ারুল হক আনু গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, ২৬ মার্চের পর থেকে হঠাৎ করেই ডিম-মুরগির দাম পড়তে থাকে। দূরের বাজারে ডিম পাঠাতে না পারার কারণে এই সমস্যা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আনোয়ারুল হক জানান, “দেশের মধ্যে জয়পুরহাট সোনালী পোল্ট্রি শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে এক নম্বর স্থান দখল করে আছে। দেশে বিভিন্ন জাতের মুরগির মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশ হয় জয়পুরহাটে।

“জয়পুরহাটের খামারে বছরে প্রায় এক লাখ ৬৮ হাজার টন সোনালি মুরগির মাংস উৎপাদন হয়। জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে পাঠানো হয়।”

তিনি বলেন, “জয়পুরহাটের খামারে বছরে ৪০ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ২৬ কোটি ডিম দিয়ে সোনালি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। অবশিষ্ট ১৪ কোটি হাইব্রিড ডিম খাওয়ার জন্য উৎপাদন করা হয়।

এ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় নয় হাজার মুরগির খামার রয়েছে জানিয়ে আনোয়ারুল বলেন, তাছাড়া শ খানেক হ্যাচারি ও ১৬টি ফিডমিল রয়েছে। সব মিলিয়ে স্থায়ী ও চলতি মূলধন হিসাবে বিনিয়োগ রয়েছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার।

মুরগির ফার্মের মতোই সংকটে পড়েছেন, গরু ও দুগ্ধ উপাদনকারী খামারের মালিকরা।

লকডাউনের এই সংকটে বেশির ভাগ মিষ্টির দোকান, রেস্তোরাঁ ও কনফেকশনারি বন্ধ। বাসাবাড়িতেও বেশির ভাগ ক্রেতা দুধ নিচ্ছেন না। অন্যদিকে, মিল্ক ভিটাছাড়া বেশির ভাগ কোম্পানি দুধ কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে, খামারিদের উৎপাদিত তরল দুধের প্রায় ৯০ শতাংশ ফেলে দিতে হচ্ছে।

পাবনার ভাঙগুরা উপজেলায় মৃত্তিকা ডেইরী ফার্মের মালিক আবদুল কাদের তার দুরবস্থার কথা বর্ণনা করে রেডিও তেহরানকে বলেন, বড়বড় কোম্পানি সিন্ডিকেট করে খামারিদের কাছ থেকে এমনিতেই কম দামে দুধ সংগ্রহ করত। এখন করোনার অজুহাতে তাদের দুধ সংগ্রহের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। তাও সপ্তাহে হয়তবা দু’দিন নিচ্ছে। দামও কমিয়ে দিয়েছে। অথচ খামার দেখাশোনা করা লোকদের মজুরি দিতে হচ্ছে এবং অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে গরুর জন্য আমদানিকরা দানাদার খাবার কিনতে হচ্ছে। তাও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।

সীমান্তবর্তী উপজেলা হাকিমপুরে ছোট-বড় মিলে অন্তত ১৩০টি খামারে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার গরু। এদের থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। লকডাউনের জন্য এ সময়ে দুধের সরবরাহ থাকলেও ক্রেতা না থাকায় লোকসানে পড়তে হয়েছে খামারিদের। গরুর খাদ্য এবং শ্রমিকের বেতন দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে খামারিদের।

এ প্রসঙ্গে হাকিমপুর উপজেলা ভেটেনারি সার্জন শ্রী রতন সরকার বলেন, বাজারে ক্রেতা অনেক কম। যেকারণে এই দুগ্ধ খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কিছূ না জানালে তারা স্থানীয়ভাবে খামারিদের কোনো সহায়তা দিতে পারছে না।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) এক প্রতিবেদন জানানো হয়েছে, দেশে বছরে ৯৯ লাখ টন তরল দুধের দরকার হয়, যার ৭০ শতাংশ দেশের খামারগুলোয় উৎপাদিত হয়। বাকিটুকু আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। বর্তমানে দেশে দিনে ১২০ থেকে ১৪০ লাখ লিটার তরল দুধ উৎপাদিত হচ্ছে, যার বেশির ভাগই অবিক্রিত থেকে নষ্ট হচ্ছে। খামারিরা এসব দুধ বিক্রি করে গরুর খাবার ও নিজেদের বাজার করে থাকেন। তাই বিক্রি না হওয়ায় গরু ও খামারি উভয়েই বিপদে পড়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাছ, মুরগি ও গবাদিপশুর জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের বড় অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মূলত, চীন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসব ওষুধ আসে। বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সেসব ওষুধ ও কাঁচামালেরও কয়েক মাসের মধ্যে সংকট দেখা দিতে পারে। এ কারণে এখন থেকে তা দ্রুত আমদানির ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অর্থনৈতিক খাতে সহায়তার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের কথা জানানো হয়েছে। শষ্য ও ফসলের খাত ছাড়া কৃষির অন্যান্য খাত- যেমন মৌসুমভিত্তিক ফুল ও ফলের চাষ এবং প্রাণিসম্পদ খাতে পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস খামারের জন্য ৪ শতাংশ সুদে এ তহবিল থেকে ঋণ দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে গঠিত এ তহবিল থেকে ১ শতাংশ সুদে অর্থ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে খামারিদের মধ্যে বিতরণ করতে বলা হয়েছে।

-পার্সটুডে