পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু অংশ বাদ

পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু অংশ বাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিচারক, আদালত ও বিচার বিভাগে দুর্নীতি নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া একটি রায়ের পর্যবেক্ষণ ও আদেশের কিছু অংশ বাদ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সোমবার (১২ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও হাইকোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানিয়েছেন।

এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাত সদস্যের ভার্চুয়াল পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট রিট মামলার রায়ে কোর্ট অব সেটেলমেন্ট-এর তৎকালীন বিচারক, আদালত ও বিচার বিভাগ সম্পর্কিত হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণসমূহ এবং আদেশ অংশের কতিপয় নির্দেশনা কর্তন করেছেন।’

সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে আপিল বিভাগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোনো দলিলপত্র উদ্ঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপিল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যে কোনো মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেইরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করিতে পারিবেন।’

তবে, হাইকোর্টের আদেশের কোন কোন নির্দেশনা বা পর্যবেক্ষণ কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করে জানাননি সাইফুর রহমান।

পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে একটি রিট মামলার রায়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ পর্যবেক্ষণসহ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

বিচারক, আদালত ও বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি ১৯৯৫ সালে ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত যে রায় দিয়েছিল, তাকে কল্পিত, জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক বলা হয়েছিল রায়ে।

রায়টি লিখেছিলেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. আশরাফুল কামাল। অন্য বিচারক রাজিক-আল-জলিল তাতে একমত পোষণ করেন।

এ রায়টি প্রকাশের পর গত ৩ অক্টোবর এবং ৪ অক্টোবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এরপর ওই রায়ের পর্যবেক্ষণ ও আদেশ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

এই আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই রায়ের পর্যবেক্ষণ ও আদেশের কিছু অংশ বাদ দিল সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশে অনেক সম্পত্তি পরিত্যক্ত বলে চিহ্নিত হয়। এসব সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা, নিষ্পত্তির ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তি) আদেশ জারি করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিংবা সামরিক অভিযানে নিয়োজিত ছিল এমন ব্যক্তি বা যে ব্যক্তি বাংলাদেশে উপস্থিত নেই বা ব্যক্তির নাম পরিচয়-ঠিকানা জানা নেই বা সম্পত্তি যে ব্যক্তির দখল-তত্ত্বাবধান, ব্যবস্থাপনায় নেই, এমন ব্যক্তির সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় আদেশে।

এই আদেশের ২৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ৮ মে বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (জমি, ভবন ও অন্যান্য সম্পত্তি) বিধিও জারি করেন।

এই বিধি অনুযায়ী পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলতে বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তি) আদেশের আওতায় যেকোনো প্রকারের নির্মিত কাঠামো ও জমিসহ ভবন (দালান/ইমারত) ও এসবের প্রয়োজনীয় সংলগ্ন অংশ, কৃষিজমি, উদ্যান (বাগান জমি) ও অকৃষি জমিসহ জমি ও বছরের যেকোনো এক সময় জলমগ্ন জমি এবং এ ধরনের জমি থেকে উদ্ভূত সুবিধাদিসহ জমিকে বোঝানো হয়।

পরে ১৯৮৫ সালে ‘পরিত্যক্ত বাড়ি (সম্পূরক বিধানাবলি) অধ্যাদেশ’ নামে একটি সম্পূরক অধ্যাদেশ জারি করে সরকার।

এ অধ্যাদেশ জারির পর ১৯৮৮ সালে কে এ এম আশরাফ উদ্দিন কাকরাইলের ৫৬/৫৭ হোল্ডিংয়ের ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৬), লুৎফুন্নেছা রহমান চার কাঠা (বাড়ি নং-৫৬/১) এবং ১৯৮৯ সালে এ কে এম ইদ্রিস হোসেন তালুকদার ও তার স্ত্রী জামিলা খাতুন সাড়ে ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৭) জমির মালিকানা দাবি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে সেগুলো বাতিল চেয়ে সেগুনবাগিচার সেটেলমেন্ট আদালতে আবেদন করেন।

আবেদনকারীরা সবাই দাবি করেন, তারা ১৯৭৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তারারাম জয়সুরিয়া ওরফে চিও রতন ওরফে তারারাম মুচির কাছ থেকে এই জমি কিনেছিলেন।

আবেদনে তারা উল্লেখ করেন, তারারাম মুচির কাছে থেকে কেনা ওই জমিতে বসবাস করা অবস্থায় ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ উল্লেখ করে ১৯৮৮ সালে ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড’ তাদের নোটিশ দেয়।

আবেদনকারীদের সে নোটিশের জবাব সন্তুষ্ট হয়ে এবং বোর্ডের ‘জয়েন্ট সার্ভে টিম’ কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জমির মালিকানা দাবিকারীদের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

পরে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত চারটি আবেদনই একসঙ্গে নিষ্পত্তি করে রায় দেয়। রায়ে আবেদন মঞ্জুর করা হয়। অর্থাৎ পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে ওই সব সম্পত্তি বাদ দেওয়া হয়।

সেটেলমেন্ট আদালতের এ রায় চ্যালেঞ্জ করে ২৫ বছর পর সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত বছর হাইকোর্টে দু’টি রিট আবেদন করে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।

আবেদনকারীদের সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

পরে চূড়ান্ত শুনানি করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর রায় দেন।

এর পরে চলতি মাসের গত ১ অক্টোবর ১৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, যাতে বলা হয়, জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার করে দুর্নীতির মূল উৎপাটনের সময় এসেছে।

১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর যে রায়টি ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত দিয়েছিল, তা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘তারারাম যে এসব সম্পত্তির মালিক ছিলেন সেটেলমেন্ট আদালতের রায়েই তা প্রমাণ হয়নি। সেটেলমেন্ট আদালত কল্পিত রায় প্রদান করেছেন, যা জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক।’