নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত বেড়ে ১১

ঢাকা: পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সারাদেশে অন্তত এগারো জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মারা গেছে সাতজন। এছাড়া বিএনপি এক নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আজকের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ১১ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ১১২ লোক আহত হয়েছে।

প্রথমবারের দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মধ্যে এসব মৃত্যুর খবর এলো। এর ফলে এ পর্যন্ত ইউপি নির্বাচনে নিহতের সংখ্যা ১১১ ছাড়িয়ে গেছে এবং আট হাজারের বেশি লোক আহত হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।

শনিবার দেশের ৪০টি জেলায় ৭১৭টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ করা হয়। সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হয় এবং চলে বিকেল চারটা পর্যন্ত।

তবে ভোটগ্রহণের আগে থেকেই কারচুপি ও সহিংসতা শুরু হয়।

এরফলে অন্তত ৫৩ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ অন্তত ৪০ চেয়ারম্যান প্রার্থী কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেছেন।

জামালপুরে নিহত চার: জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দুই আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন।

শনিবার সকালে উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের খোটারচর ইবতেদায়ী মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন- শেখপাড়া গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মাজেদ, একই গ্রামের সাত্তারের ছেলের নুরুল ইসলাম (২০), পুতুবের চর গ্রামের আমজাদ হাজির ছেলে নবম শ্রেণির নবীরুল ইসলাম ও একই গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে জিয়া (২৫)।

সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধসহ ৩০ আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে পাঁচ পুলিশ ও এক আনসার সদস্য রয়েছেন।

গুলিবিদ্ধ ৫ জন হলেন- আফতাব, মাহমুদুর, খুদু মিয়া, সখিজল শফিক, জাকিউল। তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত অন্যরা দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জামালপুর হাসাপতালে ভর্তি হয়েছেন।

নোয়াখালীতে নিহত দুই: নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় গুলিতে এক কিশোর এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তাড়া খেয়ে পালানোর সময় এক বৃদ্ধ মারা গেছেন।

উপজেলার জিরতলী ইউনিয়নে বাংলাবাজার কেবি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মো. শাকিল (১৬)।

শাকিল জিরতলী ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের মো. মিলনের ছেলে।

তার দাদা মো. হারুন বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কেন্দ্রের বাইরে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘গুলি ছুড়লে’ শাকিল গুলিবিদ্ধ হয়। শাকিলকে ঢাকায় নেওয়ার পথে তার মৃত্যু ঘটে।

এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার ইলিয়াছ শরীফ বলেন, দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের গুলিতে শাকিলের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ সেখানে কোনো গুলি ছোড়েনি, তাই পুলিশের গুলিতে শাকিলের মারা যাওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন।

এদিকে রাজগঞ্জ ইউনিয়নের দারুল উমল ফাজিল সিনিয়র মাদ্রাসা কেন্দ্রের সামনে র‌্যাবের ধাওয়া খেয়ে সবার সঙ্গে পালানোর সময় দেয়ালে মাথায় আঘাত পান সৈয়দ আহম্মদ নামে (৬০) এক ব্যক্তি।

তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান বেগমগঞ্জ থানার ওসি সাজিদুর রহমান সাজেদ।

চট্টগ্রামে নিহত তিন: চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় মো.ইয়াছিন নামে এক মেম্বার প্রার্থীসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরো অনেকে।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কর্ণফুলী থানার বড়উঠান ইউনিয়নে মো.ইয়াছিন নামে এক মেম্বার প্রার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আরো দুজন গুরুতর আহত হয়েছেন।

শনিবার দুপুর ১টার দিকে বড়উঠান ইউনিয়নের শাহ মীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

নিহত ইয়াছিন বড়উঠান ইউনিয়নের ৬ নম্বর শাহ মীরপুর ওয়ার্ড থেকে সদস্য পদে প্রার্থী ছিলেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে কর্তব্যরত এস আই জহিরুল ইসলাম বলেন, গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ইয়াছিন নামে একজনকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।

এছাড়া শরীফ (৩২) ও আলম (২০) নামে দুজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন বলেও তিনি জানান।

ঐ সংঘর্ষের জেরে আহত মোহাম্মদ হোসেন (৫০) নামে আরো একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। এই নিয়ে ওই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো দুইজনে।

এদিকে, পটিয়া উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের এক কেন্দ্রে সংঘর্ষের সময় ‘হৃদরোগে’ বাবুল শীল (৬৫) নামে এক ভোটারের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আশিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আসাদ আলী ফকির মাজার সংলগ্ন মাদ্রাসা কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সংঘর্ষের সময় মারা যান বাবুল। মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা বাবুল সেলুনে কাজ করতেন।

পটিয়া থানার ওসি রেফায়েত উল্লাহ বলেন, ভোট দিতে আসা ওই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে জানান ওসি।

তবে বাবুল শীলের ছেলে জিতেন শীল বলেন, সদস্য প্রার্থী শফিকুল ইসলাম ও নুরুল করিমের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় আমার বাবাকে মারধর করে মেরে ফেলা হয়।

এজন্য শফিকুল ইসলামের পক্ষের লোকজনদের দায়ী করেন জিতেন।

কুমিল্লায় গুলিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নিহত: কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বলরামপুরের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং পঞ্চম ধাপে ইউপি নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামালউদ্দিনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

শনিবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে ওই ইউনিয়নের নাগেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।

তিতাস থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন প্রাথমিকভাবে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন।

পঞ্চগড়ে নিহত এক: পঞ্চগড়ে নির্বাচনী সহিংসতায় মো. নাসির (৫০) নামে এক ইউপি সদস্যের সমর্থক নিহত হয়েছেন। এসময় দুই আনসার সদস্যসহ আরো ১২ জন আহত হন।

শনিবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের জোতদারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ঘটনাটি ঘটে। নিহত মো. নাসির ওই ইউনিয়নের কোরিয়া পাড়ার ফাগু মোহাম্মদের ছেলে।

নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা জানায়, গারিনাবাড়ি ইউনিয়নের নির্বাচনী ফলাফলে ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী তরিকুল ইসলাম টিউবওয়েল প্রতীকে ১১ ভোটে জয়লাভ করেন। ভোট গণনা শেষে স্থানীয় রাজমিস্ত্রি মো. নাসিরসহ ওই ইউপি সদস্য প্রার্থীর কর্মী সমর্থকরা বাড়ি ফিরছিল।

এসময় প্রতিপক্ষের কর্মী সমর্থকরা তাদের উপর ইট-পাটকেল ও লাঠিসোটা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে মো. নাসির, আনসার সদস্য সিরাজুল ইসলাম ও আমিনুল ইসলাম, স্থানীয় ভোটার মজাম্মেল হক, সাইদুল ইসলাম, নাসিরের স্ত্রী নুর জাহানসহ ১২ থেকে ১৫ জন আহত হন।

আহতদের দ্রুত পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে নাসির মারা যান। এদের সকলের বাড়ি ওই ইউনিয়নের কোরিয়া পাড়ার গ্রামে।

নিহত নাসিরের জামাতা সাইদুর রহমান বলেন, আমরা সদস্য প্রার্থী তরিকুল ইসলাম এর টিউবওয়েল প্রতীকের কর্মী ছিলাম। ভোট দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। এসময় আনসার সদস্যরা আমাদের সহায়তা করছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ আনোয়ার হোসেনের কর্মী সমর্থকরা আমাদের উপর হামলা চালায়।

পঞ্চগড় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমিনুল ইসলাম মমিন বলেন, নির্বাচন শেষে একজন নিহতে খবর নিশ্চিত করে বলেন, গরিনাবাড়ি ইউনিয়নে এক ইউপি সদস্য প্রার্থীর পক্ষে আনন্দ মিছিল করার সময় ঘটনাটি ঘটেছে বলে শুনেছি। তবে নিহতের সুরতহাল করা হচ্ছে।