নাস্তিক ব্লগার-সমকামিদের বিপরীত অবস্থানে দেশের জনগণ ও ক্ষমতাশীন দল

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ডেস্ক: হত্যাকান্ড নিয়ে উত্তপ্ত দেশের রাজনীতি, অতি সরব বিদেশি মহল। দু’সপ্তাহের মধ্যেই একের পর এক তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটলো। একজন লেখক, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অপরজন সমকামী অধিকার কর্মী। হত্যাকাণ্ডর ধরনও একই রকম। এর আগে একই কায়দায় হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন মন্দিরের পুরোহিত, প্রকাশক, লেখক-ব্লগারসহ অনেকে। হত্যাকান্ডের পর সমালোচনা ঝড়ে বেরিয়ে আসে তাদের ‘নাস্তিক’ ‘সমকামি’ কিংবা ইসলাম বিদ্বেষীতার অভিন্ন পরিচয় ও কৃতকর্মের চিত্র। এ শ্রেণীর ব্যক্তিদের হত্যাকান্ডগুলোর ধরণও একই ধরণের। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় এরা। প্রতিটি হত্যাকান্ডের পরপরই নাটকীয়ভাবে ইন্টারনেটে দায় স্বীকারের সংবাদ দিচ্ছে কথিত আইএস কিংবা আল কায়দা কিংবা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামক ভার্চুয়াল কোন সংগঠন। তারপরই শুরু হচ্ছে গণমাধ্যমের ঘাড়ে ভর করে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের হুঙ্কার-গর্জনের পর্ব।

প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ঘিরে এই নাটকীয়তাকে ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখেছেন  ক্ষমতাশীন সরকার এবং একই সাথে দেশের আপামর জনসাধারণ।

গত পহেলা বৈশাখে (১৪এপ্রিল, ২০১৬) প্রধানমন্ত্রী ধর্ম নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি যারা ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নোংরামি করে তাদেরও তীব্র নিন্দা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ধর্ম সম্পর্কে কেউ যদি নোংরা কথা লেখে, সেটা কেনো আমরা বরদাশত করবো?’

তিনি বলেন, ‘ফ্যাশন দাঁড়িয়ে গেছে ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তারা মুক্তচিন্তার ধারক! কিন্তু আমি এখানে কোনও মুক্ত চিন্তা দেখি না। আমি দেখি নোংরামি।’

“এত নোংরা নোংরা কথা কেন লিখবে? আমি আমার ধর্ম মানি, যাকে আমি নবী মানি, উনার সম্পর্কে নোংরা কথা কেউ যদি লেখে সেটা কখনোই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের যারা তাদের সম্পর্কে কেউ কিছু লিখলে তাও কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। যারা এগুলো করে তা তাদের সম্পূর্ণ নোংরা মনের পরিচয়, বিকৃত মনের পরিচয়।” বলেন শেখ হাসিনা।

‘এটা পুরোপুরিই তাদের চরিত্রের দোষ এবং তারা বিকৃত মানসিকতার’- যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘একজন মুসলমান হিসেবে আমি প্রতিনিয়ত আমার ধর্মকে অনুসরণ করে চলি। কাজেই সে ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ লিখলে আমি কষ্ট পাই।’

এসব লেখার জন্য কোনও অঘটন ঘটলে তার দায় সরকার নেবে না, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সবাইকেই সংযমতা নিয়ে চলতে হবে, শালীনতা বজায় রেখে চলতে হবে। অসভ্যতা কেউ করতে পারবে না। আর তা করলে তার দায়িত্ব আমরা নেবো না।

এছাড়া গত ১৬ এপ্রিল (২০১৬) প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের দেশের ধর্মভীরু মুসলমানরা ধর্মকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদ তৈরি করতে জানে না। পশ্চিমারাই সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করছে।’

তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা গোষ্ঠী আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ তৈরি করেছে। তারা ইরাকে আক্রমণ করে সেখানে সন্ত্রাসবাদ তৈরি করেছে। তারা লিবিয়াতে সন্ত্রাসবাদ তৈরি করেছে। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের দেশের ধর্মভীরু মুসলমানরা ধর্মকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদ তৈরি করতে জানে না।’

ইকবাল সোবহান বলেন, ‘আমাদের দেশে যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, তা কিন্তু তারাই সৃষ্টি করছে। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়।’ বাংলাদেশের গণমাধম্যের স্বাধীনতা নিয়ে মার্কিন প্রতিবেদনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রতিবেদনে আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে কথা বলেছে। তাদের এই উদ্দেশ্যমূলক ও ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এদেশের গণমাধম্যের স্বাধীনতা না থাকলে সংবাদমাধ্যম এতো বেশি বিকশিত হতে পারতো না।’

এদিকে, বাংলাদেশে সমকামিতা ‘মানানসই না’ বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি গত বুধবার (২৭ এপ্রিল) সমকামীদের অধিকার বিষয়ক পত্রিকা রূপবান-এর সম্পাদক মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী তনয় হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি জুলহাজ রূপবান নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আর তিনি সমকামিদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতেন। এটা আমাদের সমাজের সঙ্গে মানানসই না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আর আমিও আগেই বলেছি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে বা বিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারো নেই। সবাইকে সংযত হয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করার অনুরোধ করছি ।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা ও রাজধানীর কলাবাগানে জোড়া খুনের ঘটনা নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীল পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করছে। তাদের পরিকল্পনা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিহত করছে।’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলছেন, তাদের দল কোনো ধর্মকে অবমাননা করে কোনো লেখার বিষয়ে কখনোই নীরব ভূমিকা পালন করতে পারে না।

হানিফ বলেন, ‘আমরা মুসলমান হিসেবে আমাদের ধর্মের প্রতি সমর্থন থাকবে। যে দেশের নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান, সে দেশের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কেন তার বিপক্ষে যেতে হবে? আমাদের ধর্মের প্রতি যেমন সমর্থন থাকবে তেমনি অন্য ধর্মের প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধা আছে।’

উল্লেখ্য যে, ধর্ম নিয়ে আওয়ামীলীগের এই অবস্থান নতুন নয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ইসলাম বিরোধী লেখার কারণে দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল।

নব্বই’র দশকে লেখিকা তসলিমা নাসরিন ইস্যুতেও আওয়ামীলীগ তার পক্ষে দাঁড়ায়নি। এমনকি অতি সম্প্রতি হজ্ব নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে প্রভাবশালী নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল বলছেন, ইসলাম ধর্মের বিপক্ষে যায় এমন কোনো ইস্যুতে দলটি অতীতেও কোনো আপস করেনি।

অধ্যাপক নজরুল মনে করেন, ‘ধর্মকে আওয়ামী লীগ সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথাও বলেছে। যারা মনে করে আওয়ামী লীগ নাস্তিকদের পক্ষে দাঁড়াবে তারা ভুল করেন।’

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের কেউ কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেও সাধারণ মানুষের মাঝে এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান অধিকাংশ মানুষের সেন্টিমেন্টের পক্ষে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ নাস্তিক-ইসলাম বিরোধীদের বিপক্ষে ব্যাপকভাবে সাড়া দিচ্ছে পাশাপাশি ধর্ম নিয়ে কটুক্তিকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানকে স্বাগত জানাচ্ছে।