ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কুমিরের বাচ্চার মতো : হাইকোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে সকাল-বিকেল দু’বেলা পানি ছেটানোর বিষয়ে করা রিটের শুনানিতে সিটি কর্পোরেশনকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, কোথাও পানি ছেটানো হয়েছে দেখি না, পানি ছেটানো হয় শুধু ভিআইপি সড়কে। একটা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের (তালিকা) চার্ট এনে হাজির করেছেন। একই জিনিস তিনবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন, সেই যে গল্পের কুমিরের বাচ্চার মতো। তাই আমরা যথাযথ ব্যক্তিদের কাছ থেকেই শুনতে চাই।’

ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য নির্দেশনা চেয়ে করা এক রিটের শুনানির সময় হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ আজ (রোববার) এসব মন্তব্য করেছেন।
সিটি কর্পোরেশনকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতিবাজ বলবেন, চোরকে চোর বলতে হবে। যদি এটা না বলা হয় তাহলে দেশ রক্ষা করা যাবে না। আমরা বায়ুদূষণ রোধে সড়কে পানি ছেটানোর নির্দেশ দিয়েছি। ওই আদেশ কিভাবে এবং কতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেটার অগ্রগতি প্রতিবেদন চেয়েছি। কিন্তু আপনি সিটি কর্পোরেশনের একটা চার্ট (তালিকা) নিয়ে এসেছেন। আদালত বলেন, এই চার্ট অনুযায়ী তো দায়িত্বপ্রাপ্তরা কাজ নাও করতে পারে। যেখানে আমাদের সংস্কৃতি রয়েছে সরকারি গাড়ির তেল চুরি করার। বাস্তবতা তো তাই বলেন, নাকি বেশি ভালো হয়ে গেছি আমরা। এ কারণে সিটি কর্পোরেশনের এসব গাড়ির চালকরা সড়কে পানি ছেটাচ্ছে নাকি তেল চুরি করছে সেটা দেখবেন না।

শুনানিতে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সিটি কর্পোরেশনের অগ্রগতি প্রতিবেদন গ্রহণের সুযোগ নেই। ইতোপূর্বে কয়েকটি ধার্য তারিখে যে এফিডেভিট দিয়েছে আজকের এফিডেভিটের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

এ পর্যায়ে সিটি কর্পোরেশনের আইনজীবীর উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চেয়েছি। পানি কোথায় কোথায় ছেটানো হয়েছে সেই রিপোর্ট কোথায়? যে রিপোর্ট দিয়েছেন সেটা দিয়ে তো কিছু বোঝা যায় না। এরপরই হাইকোর্ট দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে তলব করে আদেশ দেন। আগামী ১৫ মে তাদের আদালতে হাজির হয়ে পানি ছেটানোর বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ঢাকা মহানগরীতে ‘ধুলাবালিপ্রবণ’ এলাকাগুলোতে সকাল ও বিকেলে দু’বার পানি ছিটাতে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, আজ পর্যন্ত পানি ছেটানো হয়েছে কি না সে বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে দুই সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে তলবও করেছেন হাইকোর্ট। গত জানুয়ারি মাসে এ আদেশ দেয়ার পর তা বাস্তবায়নে অগ্রগতির প্রতিবেদন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আগামী ১৫ মে হাজির হয়ে তাদের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান এবং বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।

শুনানির শুরুতে আদালতের আদেশ চেয়ে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন যে তিনটি প্রতিবেদন দিয়েছে তা ঘুরেফিরে প্রায় একই। আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের বিষয়ে কিংবা অগ্রগতির বিষয়ে সেখানে কিছুই বলা হয়নি। মূলত সিটি কর্পোরেশনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের চার্ট তুলে দেয়া হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের আইনজীবী নুরুন্নাহার তখন বলেন, ওই প্রতিবেদনে পানি ছিটানোর বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। আদালত বলেন, প্রতিবেদনের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এখানে তো বলা হয়নি কে, কখন, কোথায় পানি ছিটাচ্ছে। আমরা তাহলে কীভাবে বুঝব আদৌ পানি ছিটানো হচ্ছে কিনা!

আদালত এ সময় আরও বলেন, আমরা তো রাস্তায় চলি। কোথাও পানি ছিটানো হয়েছে দেখি না। পানি ছিটানো হয় শুধু ভিআইপি সড়কে। এখন আপনি একটা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের (তালিকা) চার্ট এনে হাজির করেছেন। একই জিনিস তিনবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই যে গল্পের কুমিরের বাচ্চার মতো। তাই আমরা যথাযথ ব্যক্তিদের কাছ থেকেই শুনতে চাই।’

শুনানির এক পর্যায়ে মনজিল মোরসেদ পরিবেশ অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্কটের তথ্য তুলে ধরে বলেন, পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে কাজ করতে পারছে না। বর্তমানে সাত বিভাগে মাত্র সাতজন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের। ঢাকায় মাত্র একজন। এই একজনের পক্ষে এই বিশাল এরিয়ার কাজ পরিচালনা সম্ভব না।

আদালত বলেন, ‘জনবলের সীমাবদ্ধতা তো সব জায়গাতেই রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টেরও জনবল সঙ্কট রয়েছে। যাই হোক, আমরা এখনই ম্যাজিস্টেট নিয়োগের বিষয়ে কোনো আদেশ দিচ্ছি না। তবে, আপনি পরিবেশ সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট পদায়নের বিষয়ে কথা বলুন এবং আগামী শুনানিতে আমাদের জানান।’

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের প্রতি নির্দেশনা ছিল দিনে দুইবার করে পানি ছিটাতে। যেন ধুলাটা অন্য জায়গায় ছড়াতে না পারে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে যেসব কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে, সেখানে তাদের রুটিন ওয়ার্ক তুলে ধরা হয়েছে। আদালত এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।’

ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে গণমাধ্যমে ২১ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে ২৭ জানুয়ারি একটি রিট আবেদন করা হয়। ওই রিটের শুনানি নিয়ে পরের দিন ২৮ জানুয়ারি আদালত রুলসহ পানি ছিটানোর আদেশ দেন।