ইসলাম ধর্ম বইয়ে আরবি বানান বিকৃতির দায় এড়াতে কৌশুলি এনসিটিবি

ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা

নিউজ নাইন২৪, ঢাকা: ষষ্ঠ শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিকতা শিক্ষা বইয়ে পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াত লিখতে বানান বিকৃতি ও অন্যান্য আরবি বানানে ৫৮টি ভুলের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ঠান্ডা মাথায় ভুল স্বীকার করে কৌশলে অভিযোগ ঠেলে দিচ্ছে লেখক, সম্পাদক এবং শিক্ষকদের দিকে। ভুল প্রসঙ্গে এনসিটিবির অভিযুক্তদের বক্তব্যে কৌশলে দায় এড়ানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে আরবী বানানে ৫৮টি ভুলের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি’র প্রধান সম্পাদক প্রীতিশকুমার সরকার দাবি করেছে, ‘এতদিন ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে আরবীতে লেখা পবিত্র কুরআন ও পবিত্র হাদিস-এর অংশবিশেষ পুনঃপাঠ বা বানান পরীক্ষণের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) অভিজ্ঞ কোনো লোকবল ছিল না। রচয়িতা, সম্পাদক, জাতীয় কারিকুলাম কো-অর্ডিনেটর কমিটি (এনসিসিসি), ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত, অভিভাবকদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুনঃসংযোজন বা বিয়োজন করা হতো।’

বই রচনা প্রসঙ্গে সে বলেছে, ‘যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের সে বিষয়ের পাঠ্যবই রচনা এবং সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয়। লেখক যখন একটি বই সম্পন্ন করেন, তখন সেটি সম্পাদকের সম্পাদনা শেষে এনসিসিসি কমিটিতে পাঠানো হয়। এনসিসিসিতে শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গড়া ২২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে।’

বই রচনা প্রসঙ্গে সে বলেছে, ‘যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের সে বিষয়ের পাঠ্যবই রচনা এবং সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয়। লেখক যখন একটি বই সম্পন্ন করেন, তখন সেটি সম্পাদকের সম্পাদনা শেষে এনসিসিসি কমিটিতে পাঠানো হয়। এনসিসিসিতে শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গড়া ২২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে।’

‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটির রচয়িতা হলেনা- মুহাম্মদ আবদুল মালেক, ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ, ড. মোহাম্মদ ইউছুফ, মুহাম্মদ ইউসুফ আলী শেখ, ইকবাল জাহাঙ্গীর আলম ।

বইটি সম্পাদনা করেছে, ডক্টর আখতারুজ্জামান ও মুহাম্মদ তমীযুদ্দীন। এনসিসিসি’র কার্যক্রম সম্পর্কে প্রীতিশকুমার বলেছে, ‘জাতীয় কারিকুলাম কো-অর্ডিনেটর কমিটি বইটিকে ধর্ম-রাষ্ট্র-ব্যক্তি-পক্ষপাতদুষ্ট কোনো কিছু আছে কি না তা নির্ণয় করে। অসংলগ্ন কিছু পেলে সেটিকে অধিকতর নিরীক্ষার জন্য স্পেশাল কমিটি গঠন করে। স্পেশাল কমিটির রিপোর্ট, লেখক, সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে এনসিসিসি বিষয়টি বিয়োজন বা সংযোজন করে থাকে। তারপর বইটির বিষয়বস্তুগুলো এনসিটিবিতে পাঠানো হয়।’

এতগুলো হাত ঘুরে যে বইটি তৈরি হয়, সে বইটিতে এত ভুল, যারা বইটি পড়াচ্ছে তারাও ধরতে পারেনি, এ বিষয়ে এনসিটিবি’র কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলেছে, ‘ভুলের জন্য আমরা লজ্জিত। যারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয় তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তবে দুঃখের বিষয়- কোনো শিক্ষক আজ অবধি এ বইটিতে ভুল আছে এরকম কোনো অভিযোগ বা তথ্য আমাদেরকে দেননি। শিক্ষক এবং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সে বলেছে, ‘এটার উত্তর দেয়া দুষ্কর।’ দুই বছর ধরে ভুলে ভরা বইটি শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে, এনসিটিবি প্রতি বছর বইটির পরিমার্জন বা পুনর্মুদ্রণ করছে। পরিমার্জনের ফলাফল কী হলো?

প্রীতিশকুমার বলেছে, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে সম্মানি দিয়ে রাখা হয়।’ জানা যায়, এ বইটির দায়িত্বে ছিলেন এনসিটিবি’র সদস্য (কারিকুলাম) প্রফেসর মশিউজ্জামান। আরবী বানান তদারকির জন্য ৬ মাস আগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে উম্মে কুলসুম নামে একজনকে।

গুরুত্বহীনতার কারণে এরকমটা ঘটছে কিনা? এ প্রশ্ন করা হলে মশিউজ্জামান বলেন, ‘বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ লোকবল দিয়ে বই প্রণয়ন, সম্পাদন, সুপারভিশন করা হয়। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।’ তাহলে ভুলের দায় কে নেবে? মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা তো দায় এড়াতে চাচ্ছি না। আর আপনি যে ভুলের কথা বলছেন আমি তো জানি না এগুলো কতটা ভুল। অভিযোগ পেয়েছি, এখন যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদেরকে দিয়ে এ বিষয়ে কয়টা ভুল আছে তা নিশ্চিত করতে হবে।’

যে প্রক্রিয়ার কথা আপনি বলছেন সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গত চার বছর বইটি প্রক্রিয়াজাত হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে। বইটি পরিমার্জিত, পুনর্মুদ্রণ সংস্করণ সবমিলিয়ে বিশেষজ্ঞদের হাত ঘুরে বেরিয়েছে। ভুল তো সংশোধন হয়নি। এখন কীভাবে হবে? উত্তরে মশিউজ্জামান বলেন, ‘আর কী প্রক্রিয়া আছে বলেন। বই প্রণয়নের এটাই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়। তাহলে ভুল কেন? এর উত্তর তিনি দিতে পারেননি।

উম্মে কুলসুমের কাছে একই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি সপ্তম শ্রেণীর বইটি দেখি। এ বইটি রেবেকা সুলতানা লিপি দেখেন।’ সেসময় রেবেকা সুলতানা লিপিকে পাওয়া যায়নি। লিপি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করছেন।

একাধিক শিক্ষক বলেছেন, সরকার বই ছাপিয়ে দেয়। আমাদের দায়িত্ব সরকার যা দিবে তাই পড়ানো। বইয়ে ভুল থাকলে তা এনসিটিবিকে জানাতে হবে, এরকম কোনো নিয়ম আমাদের জানা নেই। ভুলের দায়ভার নেয়ার বিষয় আসলে সরকার কাকে দিয়ে বই লিখাচ্ছে, ছাপাচ্ছে দায়টা সবার আগে তাদের নিতে হবে।

কিছুটা শিক্ষকদের মতোই অভিমত শিক্ষাবিদেরও। তাদের মতে, বই তৈরির মতো জনগুরুত্ব বিষয়ে যারা এ ধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়, সর্বাগ্রে দায়টা তাদেরই নিতে হবে। কারণ লেখক, সম্পাদক, এনসিটিবি দায়িত্বশীল-যত্নবান হলে ভুলগুলো হতো না।

ষষ্ঠ শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইটি সম্পাদনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘প্রথমবার (২০১২ সালে) পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বইটি ছাপানো হয়েছিল। ভুল ভ্রান্তি ঠিক করার জন্য এনসিটিবি ভাষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠন করবে বলেছিল। যে কমিটির মাধ্যমে বানান বা অন্যান্য ভুল সংশোধন করা হবে।’

তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এতদিন হয়ে গেল বইটি এনসিটিবি এখনো ঠিক করেনি! যেখানে শিশুদের হাতে একটি নির্ভুল বই তুলে দেয়ার কথা সেখানে কোনোভাবেই এটা দায়িত্বশীল কাজ হতে পারে না। বইটিতে যেহেতু আমাদের নাম আছে মানুষ তো মনে করবে লেখক-সম্পাদক ভুল করেছে।’

ভুলের বিষয়ে ড. আখতারুজ্জামান আরো বলেন, ‘বইয়ের ভুল দেখার দায়িত্ব আমাদের না। এটা এনসিটিবির দায়িত্ব। দেখলে এতো ভুল থাকতো না। ভুল যেহেতু আছে এর জন্য লেখক, সম্পাদক, এনসিটিবি সকলের দায় আছে। তবে এনসিটিবির সঙ্গে কথা হয়েছিল তারা বইটি ভাষা বিশেষজ্ঞ টিমের মাধ্যমে পরিমার্জিত করবে। আমরা তাদেরকে বারবার তাগিদ দিয়েছি প্রুফ দেখানো ছাড়া যাতে কোনো বই না ছাপায়।’

এনসিটিবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এনসিটিবি বিদেশি বানান রীতি দেখার জন্য একটি সেল গঠন করেছে। আশা করছি পরেরবার থেকে ভুল সংশোধন করে ছাপাবে।’

এর আগে ভুলের বিষয়ে লেখক সম্পাদক শিক্ষকদের ওপর দায় চাপালেও বিদেশি ভাষা সম্পাদনা পরিষদ না থাকা, প্রুপ ছাড়া বই ছাপনো, বিতরণ এবং লেখক সম্পাদকের ওপর দোষ চাপানোর বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় এনসিটিবির প্রধান সম্পাদকের সাথে। কিন্তু সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা আছে ‘অজুহাতে’ মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল শুধু একটি বইয়ে না। এরকম প্রায় প্রতিটি বইয়ে ভুল রয়েছে। যা কর্তৃপক্ষের অবহেলা অযত্নের কারণে হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।