কোরবানির আমেজে অর্থনীতি চাঙ্গা

ঢাকা: গত ২০১৬ সালের পবিত্র কোরবানীর ঈদে সরকার একটি দিনের পরিবর্তে একটি দিন অফিস করার শর্তে টানা ছুটি প্রদান করে। দেশের বিশিষ্টগণ সরকারের এ ঘোষণার প্রশংসাও করেন। কারণ এতে যাতায়াতে সুবিধা হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থার উপরও চাপ পড়ে কম। টানা ছুটির ফলে প্রচুর মানুষ বিদেশ অথবা দেশের অভ্যন্তরে ঘুরতে বের হয়। পর্যটন খাতও চাঙ্গা হয় এতে। যা দেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করে।
অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য বাড়ছে। ধারণামতে, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ স্বল্পসময়ের জন্য অভ্যন্তরীণ অভিবাসন করে থাকে ঈদকে কেন্দ্র করে। যাতায়াতের কারণে জনপ্রতি ১ হাজার টাকা ব্যয় হলেও এর মোট পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৩০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে কুরবানির পশু, ছুরি ইত্যাদি কেনা। মসলা-চাল-সেমাই-চিনি প্রভৃতি লেনদেন হিসাবে নিলে বাণিজ্যের পরিমাণ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

ধারণা করা হচ্ছে, এবারের কোরবানি ঈদে এক কোটির ওপর পশু কোরবানি করা হবে। এর মধ্যে গরুর সংখ্যাই বেশি। যদিও কারো কারো মধ্যে উট ও দুম্বা কোরবানির প্রবণতা বেড়ে উঠছে। ২০১৪ সালে প্রায় ৭৮ লাখ গরু ও ছাগল কোরবানি করা হয়েছিল বলে জানা যায়। বাংলাদেশে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুসারে ২০১২ সালে ৩০ লাখ গরু এবং প্রায় ৫৫ লাখ ছাগল কোরবানি করা হয়। একই সময়ে ভারত থেকেও প্রচুর গরু আমদানি হয়। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় ভারত সরকার গরু রফতানি নিষিদ্ধ করেছে ঠিকই। তার পরও দক্ষিণ ভারত গরুতে উদ্বৃত্ত হওয়ায় কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। তারা গবাদিপশুর দুধ পরিভোগ করলেও মাংস পরিভোগ করছে না। একসময় সেটি বোঝায় পরিণত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অলিখিত উপায়ে গরু রফতানির বাজার গড়ে উঠেছে। এতে অনেক মানুষ সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। বিগত বছরগুলোয় নামমাত্র কর পরিশোধপূর্বক গরু আনা হয়েছে। ১০ থেকে ২৫ লাখ পর্যন্ত গরু বিভিন্ন সময়ে আনা হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে আগে। এবারের পরিস্থিতি সম্পর্কে তেমন কিছু এখনো জানা যায়নি। তবে ভারত থেকে গরু আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে গরুর উত্পাদন কমে গেলে ভারত থেকে গরু আমদানি বেড়ে যায়।

প্রতি বছর যে বিশাল অংকের গরু-ছাগল কোরবানি দেয়া হয়, তার মধ্যে কিছু দান হিসেবে দেয়া হয়। আবার কিছু ভাগাভাগিতেও কোরবানি দেয়া হয়। এজন্য কোরবানির মাধ্যমে উপকৃত জনগোষ্ঠী প্রায় ১০ কোটির উপরে। ঈদ উপলক্ষ্যে অর্থ যায় এতিমখানায়, মাদ্রাসায়। ফলে কোরবানিকে কেন্দ্র করে শহরের বাজারগুলোয় যেমন প্রণোদনা, লেনদেন শুরু হয়, গ্রামেও তেমনটি হয়।
আবার কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে কসাই ও যারা গোশত কাটাকাটি করেন, তাদের হাতেও অর্থের সমাগম ঘটে। তাছাড়া এ সময়ে আমাদের কামার-কুমোর সম্প্রদায় চাঙ্গা হয়। অনেক সময় ইলেকট্রনিক পণ্য বিশেষ করে ফ্রিজের একটা আলাদা বাজার তৈরি হয়। অধিকন্তু মসলার আমদানি বাড়ে, সে সঙ্গে আলোচ্য বাজারে বিক্রি-বাট্টা বাড়ে, লেনদেনও বাড়ে।

বাংলাদেশ এক্ষেত্রে গবাদিপশু পালনে স্বাবলম্বী হতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত এগিয়ে এলে এটি কঠিন হবে না। এবার ধারণা করা হচ্ছে, আলোচ্য সংখ্যার মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ গবাদিপশুর জোগান আসবে স্থানীয় উত্স থেকে। কৃষকরা আমাদের মাংসের চাহিদা মেটাতে পারবেন। এছাড়া মিয়ানমার থেকে কিছু গরু ও মহিষ আসে। আমরা কখনো বড় আকারে মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি করিনি। এটি বাড়িয়ে তোলার সুযোগ রয়েছে কিনা, তা যাচাই করে দেখতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে গবাদিপশু আমদানিতে মিয়ানমার, নেপাল বড় উত্স দেশ হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা। গবাদিপশু শিল্প আরো সম্প্রসারণ করলে এবং কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পেলে দ্রুতই এ শিল্পে স্বাবলম্বী হতে পারে দেশ। গবাদিপশুর দাম যেন কৃষকরা ঠিকমতো পান, তাও নিশ্চিত করতে হবে।

ব্ল্যাক গোট বা কালো ছাগল কুষ্টিয়ায় উত্পাদন হয়। যশোরেও উত্পাদন হচ্ছে এখন। বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, সেগুলো বিক্রি করে কৃষকরা ভালোই দাম পাচ্ছেন। আমরা সাধারণ মানুষের হাতে আরো বেশি টাকা-পয়সা তুলে দিতে চাই, যাতে শিল্প-কারখানায় উত্পাদিত পণ্যগুলো কৃষকরা নিজেদের উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার মাধ্যমে কিনতে পারেন, পরিভোগ করতে পারেন। এটা আমাদের সবার কাম্যও বটে।

আমরা এটাও দেখেছি, কয়েক বছর ধরে আমরা যে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ গরু কোরবানি দেই, তার মধ্যে কিছু গরু জাকাত বা দান হিসেবে দেয়া হয়। আবার কিছু ভাগাভাগিতেও কোরবানি দেয়া হয়। এজন্য কোরবানির মাধ্যমে উপকৃত জনগোষ্ঠী প্রায় সাত থেকে আট কোটির কাছাকাছি। ঈদ উপলক্ষে ব্যবসায়ীদের অনেকে জাকাত ফান্ডে অর্থ দিয়ে থাকেন। অর্থ দেন এতিমখানায়, মাদ্রাসায়। ফলে কোরবানিকে কেন্দ্র করে শহরের বাজারগুলোয় যেমন প্রণোদনা, লেনদেন শুরু হয়, গ্রামেও তেমনটি হয়। সবচেয়ে বড় কথা, যারা গরুটি লালন-পালন করেছেন, তারা অনেক অর্থ পান।

আবার কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে কসাই ও যারা মাংস কাটাকাটি করেন, তাদের হাতেও অর্থের সমাগম ঘটে। হুজুর, ইমাম, মুয়াজ্জিনরা কিছু অর্থ পেয়ে থাকেন। তাছাড়া এটাকে কেন্দ্র করে আমাদের কামার-কুমোর সম্প্রদায় চাঙ্গা হয়। অনেক সময় ইলেকট্রনিক পণ্য বিশেষ করে ফ্রিজের একটা আলাদা বাজার তৈরি হয়। অধিকন্তু মসলার আমদানি বাড়ে, সেসঙ্গে আলোচ্য বাজারে বিক্রি-বাট্টা বাড়ে, লেনদেনও বাড়ে। এজন্য বলছি, ঈদকে কেন্দ্র করে উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় আট কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কোরবানি ঈদের সময় রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়ে ওঠে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাড়তি গতি এনে দেয়।

লক্ষণীয়, প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ করা হয় কোরবানি ঈদের সময়। মূলত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে কোরবানির অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি গরু বা মহিষের গড় দাম ২০ হাজার টাকা করে ধরলে কোরবানি বাবদ আমাদের খরচ হচ্ছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। যদিও ২০ হাজার টাকায় এখন আর গরু পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি গরুর দাম ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা। কিছু গরু চার, পাঁচ, এমনকি আট লাখ টাকাও বিক্রি হতে দেখা যায়। কাজেই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কেবল গরু বা মহিষের পেছনে ব্যয় করা হয় কোরবানির সময়।

আবার প্রতিটি খাসি বা ছাগলের গড় দাম ১০ হাজার টাকা ধরে ৫০ লাখ খাসি বা বকরি চিন্তা করলে আমাদের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কোরবানিকে কেন্দ্র করে চামড়া সংগ্রহ বাবদ ব্যাংক বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রায় ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়। বেসরকারিগুলোও ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের অভিজ্ঞতা খারাপই বলা যায়। আমাদের চামড়াজাত দ্রব্যের রফতানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেলেও ঋণটা যাচ্ছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। এখন সময় এসেছে ওই ঋণের কিছু গবাদিপশু পালনকারীদের দেয়া যায় কিনা সেটা ভাবার। যতটুকু জানি, কিছু বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এ বিষয়ে উদ্যোগও নিয়েছে।

এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. চামড়ার দাম খুব একটা বাড়ছে না। দুই. চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পে যে ব্যাংকঋণ দেয়া হচ্ছে, তা ফেরত আসছে না। কিংবা এলেও খুবই কম। সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, চামড়া শিল্পে দেয়া ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই শ্রেণীবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা ভালো নয়। আরেকটি বিষয়, আমরা এখনো চামড়া সংগ্রহ ব্যবস্থা উন্নত করতে পারিনি। রফতানিকারক, উত্পাদক ও সংগ্রাহকরা চামড়ার সঠিক মূল্য পান না বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়।

কোরবানির ঈদের সময় আরেকটি বিষয় ইদানীং দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে, জাকাত বা দান-খয়রাত করা। কত লোক জাকাত দেয়, এ বিষয়ে শুধু অনুমান রয়েছে। সঠিক কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাকাত লেনদেন হয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। আবার চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট কিংবা উত্তরবঙ্গে অনেক ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চেক দেন না, কিন্তু জাকাত কড়ায় গণ্ডায় আদায় করেন। সেটি চিন্তা করা হলে জাকাতের আকারও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা হবে।

সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় দেখতে পাচ্ছি, কোরবানির অর্থনীতিটা ফি-বছর বড় হচ্ছে। আগে শুধু কোরবানি দেয়াটাই ছিল মুখ্য। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পর্যটন। যুক্ত হয়েছে ঈদ বোনাস। সব মিলিয়ে একটি ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে অর্থনীতিতে। ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক পেশার বিস্তার ঘটছে। সেটাকে কেন্দ্র করে কোরবানির অর্থনীতিও বড় হচ্ছে। যেখানে রমজানের ঈদের অর্থনীতি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা, সেখানে কোরবানির অর্থনীতির আকার প্রায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ইদানীং লক্ষ করছি, ফ্রিজ, টিভি প্রভৃতি পণ্যের বিক্রি বাড়ছে কোরবানির সময়। অনেক সেলফোন কোম্পানি ঈদ ধামাকার ব্যবস্থা করছে। কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে টাকার লেনদেন বাড়ছে। নতুন নোটের সার্কুলেশন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ভালোভাবেই এটাকে সামাল দিচ্ছে। এ সময়ে কলমানি রেট নিয়ন্ত্রণে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তহবিল ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার দেখাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তারাও চেষ্টা করছেন বোনাসের টাকাটা ভালোভাবে ব্যবহার করতে। সামগ্রিকভাবে লেনদেন বাড়ছে। ফলে কোরবানির ঈদ একটা বৃহত্তর উত্সবে রূপ নিয়েছে। মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে, লেনদেন বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগছে। একটি ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে, যাতে সহযোগী শিল্পগুলো প্রণোদিত হতে পারে। সব মিলিয়ে উত্সবমুখর মানুষের সত্যিকারের উত্সবে পরিণত হচ্ছে এ ঈদ।