আশ্রয় কেন্দ্রে মানবেতর অবস্থায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা

রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের স্কুল-মাদ্রাসাগুলো এখন শরণার্থী শিবির। কোথাও জায়গা না পেয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৭২টি স্কুল-মাদ্রাসায় আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা এসব আশ্রয় কেন্দ্রে মানবেতর অবস্থায় দিনযাপন করছেন। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তালিকা করে এসব শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হবে বলে জানায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো। ১২ থেকে ১২ ফিটের তাঁবুর নিচে রয়েছে চার পরিবারে ৩০ জন সদস্য। এদের মধ্যে ২১ জন শিশু। রোদ বৃষ্টি আবহাওয়ায় আধা ভুখা এই মানুষরা বসে বসে রাত পার হলেই হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের।
তারা বলেন, কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে। খাবার পানি পাচ্ছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। সারা রাত বসে থাকি ভাত খেতে পাই না। ঘুমাতেও পারি না। আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। যারা কিছু জায়গা পেয়েছেন মাথা গোজার তারা সেখানে ঠায় করে নিয়েছেন। সেখানে যে সব স্কুল ও মাদ্রাসা রয়েছে প্রত্যেকটির অবস্থা এই মুহূর্তে কোথায়ও পা ফেলার জায়গা নেই। উখিয়ার প্রত্যেকটিতে রেজিস্টার্ড শিবির রয়েছে।
নতুন শরণার্থীরা আসার কারণে প্রত্যেকেই এখানে গাদাগাদি করে যেভাবে পেরেছেন সেভাবেই অবস্থান করছেন। এখন পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্কুল এবং মাদ্রাসায় এক থেকে দেড়শ পরিবার অবস্থান নিয়েছে। শরণার্থীদের স্কুলগুলোতে শ্রেণিকক্ষ থাকলেও শিক্ষার্থীদের দেখা যায়না এখন। এখানকার ১২টি স্কুল ও মাদ্রাসায় এখন আশ্রয় নিয়েছেন হাজার হাজার নতুন শরণার্থী।
তারা জানান, ‘থাকার ভাল ব্যবস্থা নাই। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে অশান্তিতে আছি। কোন রকম আছি আমরা। চারিদিকে এত মানুষ ভাল করে ঘুমাতে পারি না।’ এ রকম পরিস্থিতিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে। স্কুলের একজন শিক্ষক বলেন, আমাদের শিক্ষকরা বিভিন্ন কাজে উনাদের সহযোগিতা করছেন। রান্না থেকে শুরু করে রোগীর সেবা সব ধরনের কাজ করছে তারা। নতুন শরণার্থীদের নিবন্ধনের কাজ শেষ হলে এবং শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা হলে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তারা।
নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ভিড় বাড়ছে কক্সবাজারের হাসপাতালগুলোতে-
কক্সবাজারের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে রোহিঙ্গাদের ভিড়। কক্সবাজারের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভিড়। গুলিবিদ্ধ ও আগুনে ঝলসানো শরীর নিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। জনবল কম থাকায় স্থানীয়দের পাশাপাশি রোহিঙ্গা রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের। তবে আলাদা বিভাগ খুলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার।
মিয়ানমারে সহিংতার পর থেকেই কক্সবাজার সদর হাসপাতালসহ স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ হচ্ছে নির্যাতিত রোহিঙ্গা রোগীদের সারি। দগ্ধ ও গুলিবিদ্ধ হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ভর্তি হচ্ছেন কক্সবাজারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। সেই সাথে রয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর চাপ। ফলে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় এক কক্ষেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে অনেককে। আর মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা রোহিঙ্গারা জানালেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা।
রোহিঙ্গারা বলেন, ছুড়ি দিয়ে মেরে ফেলেছে আমাদের আত্মীয়দের। ঘর বাড়ি পুরিয়ে ফেলার পর বিলের দিকে গেলে অনেক গুলি করে মেরে ফেলেছে। এছাড়া অনেককে এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলেছে। এদিকে জনবল কম থাকায় স্থানীয়দের পাশাপাশি রোহিঙ্গা রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শামসুর নাহার বলেন, তারা আমাদের বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। তারপরেও আমরা চাচ্ছি যতদুর আমাদের করা সম্ভব আমরা তাই করছি। আর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী জানালেন, আলাদা বিভাগ খুলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের এক সঙ্গে চিকিৎসা হওয়ার কারণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়ার জন্যে আমরা রোহিঙ্গাদের জন্যে আলাদ ইউনিট করেছি। বুধবার পর্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৭০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আর অবস্থার অবনতি হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ৪০ জন রোহিঙ্গাকে।
৩০ নলকূপই ভরসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার-
নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। কবে নাগাদ রোহিঙ্গা আসা বন্ধ হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। এসব সংকট ছাড়াও রয়েছে বাসস্থানের সমস্যা। কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বালুখালী ঢাল পাহাড় পর্যন্ত ছোট বড় ১৭টি পাহাড়ে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া পালংখালী,থ্যাংখালী ও টেকনাফের উনছিপ্রাং-এর বিভিন্ন পাহাড়েও আশ্রয় নিয়েছে তারা। তাদের সবাইকে এখনও স্যানিটেশনের আওতায় আনা যায়নি। ফলে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত এসব এলাকায় ১৮০০ টয়লেট এবং ৩০টির মতো নলকূপ বসানো হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এ তথ্য জানিয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন পাহাড় ও টিলায় ছড়িয়ে পড়ায় তাদের সবাইকে এই ব্যবস্থার মধ্যে আনা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা দিতে এসেছেন ডা. ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নূন্যতম স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে রাখা না গেলে নারী ও শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবেন। এরমধ্যে চর্মরোগ অন্যতম। এছাড়াও জন্ডিস, জ্বর, কাশি ও নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তারা রোদ, বৃষ্টির মধ্যে থাকছে। নতুন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাচ্ছে,যা তাদের শরীরে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য আসছে।’
বালুখালী, কুতুপালং ও উনছিপ্রাং এলাকা ঘুরে দেখা গেছে,পাহাড়ে রোহিঙ্গারা নিজেদের মতো ঘর বানিয়ে থাকছে। যে জায়গায় খাচ্ছে, থাকছে তার আশেপাশেই মলমূত্র ত্যাগ করছে। চারদিকে মশা,মাছি উড়ছে। অনেকে আবার পলিথিনের বেড়া দিয়ে টয়লেট তৈরি করেছে খোলা জায়গায়।
এদিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীরা একই পোশাকে আট-দশদিন থাকছেন। গায়েই তাদের কাপড় ভিজছে, আবার শুকাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। হাজেরা খাতুন নামে এক নারী বলেন, ‘মংডুর ম্যারুল্লার শিকদার পাড়া থেকে আমরা আসছি। আমার সাত ছেলে ও তিন মেয়ে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কোনও কাপড় নিতে পারিনি। দৌঁড়ে পালিয়ে আসছি।’
রোহিঙ্গা নারীরা সবাই বোরকা পড়ে থাকেন। স্যাঁতসেঁতে রাস্তা ও পাহাড়ে তারা সারাদিন বোরকা পরেই থাকেন। বৃষ্টির পানি,কাদামাটিতে বোরকা ভিজে একাকার। কিন্তু তারপরও তাদের খাবারের জন্য রাস্তার ধারেই বসে থাকতে হচ্ছে।
হাবিবা নামে এক রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা হয় বৃহস্পতিবার বিকালে। তিনি বলেন,‘আমরা এখনও কোথাও ঘর বানাতে পারিনি, রাস্তায় থাকছি। টাকাও নাই।’
জ্বরে আক্রান্ত এই নারী বলেন, ‘দুপুরে মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে ওষুধ নিয়েছি,তারপরও জ্বর বাড়ছেই। মংডু থেকে যে কাপড় পরে বের হয়েছিলাম,সেই একই কাপড়ে এখনও।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রে একেএম লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের নির্ধারিত জায়গায় আনার চেষ্টা করছি। এতো বড় সংখ্যা যে তাদের ম্যানেজ করে একই জায়গায় আনা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও আমরা তাদের একই জায়গায় নেবো। তা না হলে তাদের সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া যাবে না।’
রাখাইন রাজ্যে আগুন জ্বলছেই: রাখাইনের রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এখনও আগুন জ্বলছে। রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর এখনও পোড়ানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মংডুর রোহিঙ্গা দং এলাকায় আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গারা তা দেখে বিলাপ করছেন।