পুরান ঢাকায় কোরবানি ঈদের ইতিহাস

নিউজ নাইন ২৪ ডটকম:

ঈদুল আজহা পালনের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকাবাসীর রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। যদিও দেড়-দুই শ বছর আগে হিন্দু অধ্যুষিত ঢাকাই সমাজব্যবস্থায় গরু কোরবানি দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কথাসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের ‘আত্মকথা’ অনুযায়ী হিন্দু জমিদাররা তখন গরু কোরবানিকে অনুৎসাহিত করতেন। কোরবানি দিতে হতো ছাগল বা বকরি। যে কারণে কোরবানির ঈদ পুরান ঢাকায় ‘বকরি ঈদ’ নামেও পরিচিতি পায়। জেমস টেলরের মতে, ১৮৩৮ সালে শহরের বণিকদের ভেতর চার-পাঁচজন মুসলমান ও সমসংখ্যক খ্রিস্টান ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন হিন্দু। এখনকার মতো তখন ঘরে ঘরে কোরবানি দেওয়ার মতো সমাজে তত বেশি বিত্তশালী ব্যক্তিও ছিল না। তবে মহল্লাপ্রধান বা সরদারের বাড়িতে প্রতি ঈদুল আজহায় একাধিক গরু-ছাগল কোরবানি দেওয়া হতো। তা ছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ও দৈন্যতা ছিল লক্ষণীয়। ১৯০৩ সালের সরকারি ছুটির তালিকা থেকে পাওয়া যায়, মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি ছিল মাত্র এক দিন। মূলত সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়ে ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় ধুমধামের সঙ্গে ‘কোরবানির ঈদ’ পালিত হতে শুরু করে।

full_1656544451_1489033887

চাঁদ দেখা 

আহসান মঞ্জিলের নওয়াবদের আমলে কোরবানির ঈদ পালনের ব্যাপারে তারবার্তা আসত দিল্লি থেকে। তারপর তা জানিয়ে দেওয়া হতো পুরো শহরে। ঈদুল আজহার চাঁদ দেখা নিয়ে মতানৈক্যের ইতিহাস আছে। যা জানা যায়, অনুপম হায়াতের ‘নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে উল্লিখিত ১৯২২ সালের ৩ আগস্টের দিনলিপি ও নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থ  থেকে।

 

ঢাকাইয়াদের পছন্দ মিরকাদিমের সাদা গরু

একালে যেমন মাঠে-ময়দানে, রাস্তায় রাস্তায় গরুর হাট বসে, সেকালে তেমনটি ছিল না। সেকালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল যেমন কম, কোরবানির পশুর সংখ্যাও ছিল তেমনি সীমিত। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা যেমন—রহমতগঞ্জ, গাবতলী, সোয়ারীঘাট, জিঞ্জিরায় গরুর হাট বসত। বিশেষত ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনির নামে রহমতগঞ্জের হাটটি ছিল প্রসিদ্ধ, যা গনি মিয়ার হাট নামে পরিচিত। এই হাটের প্রচার কৌশলটিও ছিল বেশ চমকপ্রদ। হাটের ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে চিৎকার করে বলত, ‘ধার করো, কর্জ করো, গনি মিয়ার হাট করো। ’ হাটে মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম বাজার থেকে আসত সাদা নাদুসনুদুস গাই গরু। পরিমাণে কম হলেও আসে এখনো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উত্কৃষ্টমানের মিরকাদিমের ওই গরু কিনতে আসেন বিত্তশালী ও ব্যবসায়ীরা। গরুগুলো বিশেষ পরিচর্যায় পালিত হয়। এ গরুর গোশত বেশ সুস্বাদু। সাধারণত খৈল, ভুসি, খুদ, কুঁড়া ইত্যাদি খাওয়ানো হয় এসব গরুকে।

 

ঈদের সকাল

সকালে গরু নিয়ে যাওয়া হতো বুড়িগঙ্গা নদীতে। শ্যামবাজার ঘাটে গরু আর মানুষের ঢল নামত। এখন অবশ্য সে দৃশ্য চিন্তাও করা বাতুলতা। পুরান ঢাকাবাসীর কারো কারো মধ্যে ঈদের সকালে কিছু না খেয়ে থাকার রেওয়াজ ছিল, এখনো আছে। কেউ কেউ আবার হাতে বানানো সেমাই খেয়ে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদের জামাতে শরিক হয়। দুপুরে রান্না করা কোরবানির মাংস দিয়ে শুরু হয় আদি ঢাকাবাসীর ঈদ ভোজনপর্ব।

 

বিশেষ পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ

কোরবানির মাংস সংরক্ষণের জন্য তখনো শীতক যন্ত্রের প্রচলন হয়নি। রান্না করা গোশত কিভাবে দীর্ঘদিন রেখে খাওয়া যায়, তার ব্যবস্থাবিধি সেকালের রমণীদের আয়ত্তে ছিল। মাংস শুকিয়ে অথবা গরুর চর্বির মধ্যে বিশেষ কায়দায় মাংস ডুবিয়ে ছয়-সাত মাস পর্যন্ত রাখার রেওয়াজ ছিল, কখনো কখনো যার পরিসমাপ্তি ঘটত মহররমের আশুরার দিন।

ঐতিহ্যের ঢাকাই মিষ্টি

ঢাকাবাসীর বৈচিত্র্যপূর্ণ রান্না

কোরবানির মাংস দিয়ে ঢাকাবাসী তৈরি করত নানা রকমের খাদ্যদ্রব্য। কিছু পদ বিলুপ্ত হলেও এরই মধ্যে নতুন করে আরো কিছু পদ যুক্ত হয়েছে ঢাকাইয়াদের ঈদুল আজহার খাদ্য তালিকায়। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে চলে অঢেল গোশত দিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ রান্নার মহড়া। ঢাকাবাসীর রান্নার গুণকীর্তন অনেক লেখকই করেছেন। হেকিম হাবীবুর রহমান ‘ঢাকা : পঞ্চাশ বছর আগে’ শীর্ষক গ্রন্থে ঢাকাবাসীর তৈরি কাবাব, কোপ্তা, কালিয়াসহ  নানা রকমের মাংসজাত খাদ্যদ্রব্যের গুণকীর্তন করেছেন। এ ক্ষেত্রে ঢাকাবাসী যে কী রকম উদ্ভাবনী সৃষ্টির অধিকারী ছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি এক কোপ্তা সম্পর্কেই লিখেছেন—‘ঢাকায় যেভাবে কোপ্তা তৈরি হয় তা অন্য কোনোখানে খুব কমই দেখা গেছে। কাঁচা গোশতের কোপ্তা, সিদ্ধ গোশতের কোপ্তা, কাঁচা-সিদ্ধ গোশতের মিশ্রিত কোপ্তা…’

 

বকরি নিয়ে ঢাকাইয়া রসিকতা

একদিন এক ঢাকাইয়া বিক্রেতা একপাল ছাগল নিয়ে হাটের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক অস্থানীয় ব্যক্তি বিক্রেতাকে ‘এই ছাগল, এই ছাগল’ বলে ডাকল। ডাক না শুনে বিক্রেতা চলে যাচ্ছিলেন দেখে ওই ব্যক্তি আরো জোড়ে ‘এই ছাগল, এই ছাগল, শুনতে পাও না?’ বলে ডাকল। এ পর্যায়ে বিক্রেতা থেমে যান এবং পালের একটি ছাগল কান ধরে টেনে নিয়ে ওই ব্যক্তির সামনে দাঁড় করান। অতঃপর ছাগলের গালে খুব জোড়ে চড় মারেন, আর বলতে থাকেন : ‘হালার পু হালা, কানে হুনবার পাও না? তোমার বাপে তো বেচইন হইয়া চিল্লাইবার লাগছে!’ অস্থানীয় ব্যক্তি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করে।

 

সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও লেখকদের স্মৃতিচারণা

লালবাগের আদি বাসিন্দা নতুন দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মযহারুল ইসলাম বাবলা জানান, ‘অতীত আর বর্তমানের ঈদ পালনে বিস্তর ফারাক রয়েছে। স্থানীয় আদি ঢাকাবাসী বিত্তবানরা একাধিক গরু কোরবানি দিতেন। একটি গরু একা কোরবানি দেওয়ার মতো মধ্যবিত্তের অভাব ছিল। আর স্থানীয়দের মধ্যে ভাগে কোরবানি দেওয়ার কোনো রেওয়াজ অতীতে ছিল না, আজও নেই। কোরবানি দেওয়া মানুষের সংখ্যা তখন এত ব্যাপক আকারে ছিল না। কোরবানির গরু কেনার ক্ষেত্রে আকার ও দামের একটা প্রতিযোগিতা ছিল, এখনো আছে। কে কত দামে কয়টি ও কত বড় গরু কিনছে, এ নিয়ে হতো ঠাণ্ডা লড়াই। রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাট, গাবতলী, রমনা রেসকোর্স, হোসেনি দালান সংলগ্ন মাঠে গরুর হাট বসত। মিরকাদিমের সাদা গাভির কদর স্থানীয়দের কাছে আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই রয়েছে। ’ ঢাকার আদি বাসিন্দা শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার সাত দশকে’ লিখেছেন, ‘ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকে দাবড়ে বেড়াতাম পুরো মহল্লায়, কে কত বড় আর কত সুন্দর গরু কিনল দেখার জন্য। ঈদের নামাজের পরই ছোটাছুটি শুরু হয়ে যেত আমাদের—কোন গরুকে কিভাবে ফেলা হলো, কোন গরুকে ফেলতে কত কষ্ট হলো, কোন গরুকে তিন-চারবার ফেলার পরও উঠে দাঁড়িয়ে গেল—এসব দেখার জন্য। বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন দুটি করে বড় গরু কোরবানি হতো আমাদের বাড়িতে প্রতিবছর। ঈদে আমরা কখনো খাসি বা বকরি কোরবানি করতাম না, ষাঁড় কোরবানি করতাম। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথমবার কোরবানি দিই ১৯৫৩-৫৪ সালে, ১৫-১৬ বছর বয়সে। ভাড়া করা গাড়িতে গিয়েছিলাম ফতুল্লার হাটে। যতটুকু মনে পড়ে ৬০-৬৫ টাকা দিয়ে একটি ষাঁড় কিনেছিলাম। চারজন লোক ভাড়া করেছিলাম। ওরা ফতুল্লা থেকে ষাঁড়টা নিয়ে আসে আমলীগোলায়। মাংস হয়েছিল সাত থেকে আট মণ। কোরবানি দিতাম সাধারণত ঈদের পরদিন। ’ বংশাল নিবাসী হাসমত আরা বেগম কোরবানির ঈদ সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন এভাবে—‘মুসলিম গার্লস  স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে আমি ম্যাট্রিক পাস করি। আমাদের পরিবারে কোরবানির ঈদের অনুষঙ্গ হিসেবে জিলহজ মাসের দুটি নফল রোজা রাখা এবং নিয়ম মেনে ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’—এ দোয়া পড়ার প্রচলন রয়েছে। ঈদের খাবার আয়োজনে থাকে কাবাব, কোপ্তা, সুরুয়াসহ আরো বিবিধ। ’ একালেই হোক আর সেকালেই হোক ঈদুল আজহার শিক্ষা চিরন্তন ও শাশ্বত! আড়ম্বরের প্রতিযোগিতায় যাতে কোরবানির মাহাত্ম্য হারিয়ে না যায়। ঈদুল আজহার আদর্শ সর্বদাই মানুষকে উজ্জীবিত করবে ত্যাগ ও আত্মবিসর্জনের কল্যাণ পথে এটাই গুণীজনদের প্রত্যাশা।