ধর্মব্যবসায়ী দলগুলোই সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক

ডেস্ক: দেশে নাশকতামূলক বোমা-গ্রেনেড হামলার পুরোধা হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সঙ্গে আগাগোড়াই ধর্মব্যবসায়ী কয়েকটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের যোগাযোগ ছিলো। বড় ধরনের হামলার আগে এমন সব দলের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতার সঙ্গে পরামর্শও করেছে সন্ত্রাসবাদীরা।
বিভিন্ন সময়ে আটক এবং রিমান্ডে থাকা অবস্থায় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে সন্ত্রাসবাদীরা এ সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরকে। এসব জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেয়া জবানবন্দি এবং বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে মজুদ রয়েছে।
২০০৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে থাকা অবস্থায় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে মুফতে হান্নান এ সংক্রান্ত তথ্য দিতে গিয়ে বলেছে যে, ‘২০০৪ সালের প্রথম দিকে সংগঠনের (তাদের ভাষায়) জিহাদের কাজের (আসলে নাশকতার) বিষয় আলোচনার সময় সিলেটের বিপুল জানায়, সংগঠনের কাজ করতে হলে আমাদের কিছু মালামাল (অর্থাৎ বোমা-গ্রেনেড) দরকার। তখন আমি (মুফতে হান্নান) বলি যে, ইসলামী ঐক্যজোট থেকে আমাদের বলা হয়েছে, দেশে বোমাবাজি হয়ে লোকজন মারা গেলে সরকারের দুর্নাম হয়। বোমাবাজি সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করে দিয়েছে।’
মুফতে শহিদুল: জোট সরকারের সময়ে মুফতে হান্নানকে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার আগে খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর (সহ-সভাপতি) ও বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরীক খেলাফত মজলিসের (শায়খুল হদস আজিজুল ওরফে আজাযিল) সাবেক সাংসদ মুফতে শহিদুল ইসলামের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় বলে মুফতে হান্নান জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে। এসব জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেয়া জবানবন্দি এবং বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ওহাবীদের এজেন্ট মুফতে শহিদুল রাজনীতিতে জড়ানোর আগে থেকেই সন্ত্রাসবাদীদের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সন্দেহের তালিকায় ছিলো। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৯ সালে জনকণ্ঠ কার্যালয়ে টাইম বোমা পাঠানো, খুলনায় কাদিয়ানী উপাসনালয়ে বোমা হামলা ও মিরপুরে একটি মসজিদ থেকে বোমা উদ্ধার মামলায় মুফতে শহিদুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়েছিলো। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। এরপর জোট সরকার ক্ষমতায় এলে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে খুলনা কাদিয়ানী উপাসনালয়ে বোমা হামলার মামলাটি শেষ করে দেয়। রাজনৈতিক মামলা দেখিয়ে বাকি দুটি মামলা থেকে মুফতে শহিদুল অব্যাহতি পায়।
সন্ত্রাসবাদী গডফাদার মুফতে শহিদুলের সঙ্গে বিদেশী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীরও সম্পর্ক আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সন্ত্রাসবাদী গডফাদার মুফতে শহিদুলের আমন্ত্রণে ২০০৫ সালে পাকিস্তান থেকে আফগান সন্ত্রাসবাদী নেতা হাজ্জাব বিন কামরান এ দেশে এসেছিলো। এর আগে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হরকাতুল মুজাহিদীনের নেতা মালানা ফজলুর রহমানের সঙ্গে একাধিক গোপন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নেতাদের বৈঠক হয় বলে বৈঠক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।
সেনা সমর্থিত বিগত ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর মুফতে শহিদুল গ্রেপ্তার হয়। সে ইসলামের নাম ভাঙিয়ে এনজিও খুলে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা এনে ওহাবী মতবাদ ও সন্ত্রাসবাদীবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে।
দেশে নাশকতামূলক বোমা-গ্রেনেড হামলার পুরোধা হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সঙ্গে আগাগোড়াই ধর্মব্যবসায়ী কয়েকটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের যোগাযোগ ছিলো। বড় ধরনের হামলার আগে এমন সব দলের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতার সঙ্গে পরামর্শও করেছে সন্ত্রাসবাদীরা।
কলম বেচা মালানা মাহিউদ্দীন ও জমিয়তে ওলামা ইসলাম: গ্রেপ্তারের পর ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর বিকেলে মুফতে হান্নানকে র‌্যাব সদর দপ্তরে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয়। তখন র‌্যাব কর্মকর্তাদের সামনেই সন্ত্রাসবাদী নেতা মুফতে হান্নান সাংবাদিকদের বলে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মাসিক মদীনা পত্রিকার কলম বেচা (নীতিহীন ও ধর্মব্যবসায়ী) সম্পাদক মালানা মাহিউদ্দীন খানের মাধ্যমে সে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় বলেও সে জানায়।
ওই বছরের ২ অক্টোবর এ খবরটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ওই দিনই জমিয়তে ওলামা ইসলামের সভাপতি ও ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশ) সহ-সভাপতি মালানা মাহিউদ্দীন (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম ধ্বংসকারী) সংবাদ সম্মেলন করে (সন্ত্রাসবাদী নেতা) মুফতে হান্নানের মামলা প্রত্যাহারের তদবিরের কথা অস্বীকার করে। তখন সে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলে যে, ‘মুফতি হান্নানকে আমি ভালোভাবে চিনি। সে সাহসী ছেলে।’ ওই সংবাদ সম্মেলনে মুফতে ফজলুল হক আমিনী ওরফে কমিনী উপস্থিত ছিলো। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর ২০০৫)।
মালানা মাহিউদ্দীনের জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের অঙ্গসংগঠন ছাত্র জমিয়তের সুনামগঞ্জের সদর উপজেলা শাখার সেক্রেটারি সৈয়দ নাইম ওরফে নিমুÑ যে কি-না হুজি সদস্য, সে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপর গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি জড়িত ও হুজি’র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল ওরফে আবু জর ছিলো জমিয়তে ওলামা ইসলামের একাংশের ঝিনাইদহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আর দলের জেলা সভাপতি মুফতে আরিফ বিল্লাহ।
তথাকথিত ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ ও খেলাফত মজলিসের (শায়খুল হদস আজিজুল) ঝিনাদইদহ জেলা সভাপতি মালানা মোহাম্মদ হাসান কর্তৃক ২০০৮ সালের মার্চে মিডিয়াকে প্রদত্ত তথ্যে জানা গেছে, বুলবুল ও আরিফ বিল্লাহ জমিয়তে ওলামা ইসলামের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলো। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনে মুফতে আরিফ বিল্লাহ জমিয়তে ওলামা ইসলামের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্রও (ঝিনাইদহ-২ আসন) জমা দিয়েছিলো।
যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে  দেয়া জবানবন্দিতে সন্ত্রাসবাদী নেতা মুফতে হান্নান বলেছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে সে হুজি নেতা মুফতে আরিফ বিল্লাহকে টেলিফোনে ঢাকায় আসার জন্য বলেছিলো। অবশ্য সে আসেনি।
দেশে নাশকতামূলক বোমা-গ্রেনেড হামলার পুরোধা হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সঙ্গে আগাগোড়াই ধর্মব্যবসায়ী কয়েকটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের যোগাযোগ ছিলো। বড় ধরনের হামলার আগে এমন সব দলের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতার সঙ্গে পরামর্শও করেছে সন্ত্রাসবাদীরা।
খেলাফত মজলিস: ২০০৭ সালর ২৮ অক্টোবর মাগুরা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার হয় খেলাফত মজলিসের (শায়খুল হদস আজিজুল হক ওরফে আজাযিল-এর নেতৃত্বাধীন) মাগুরা জেলা আমীর মালানা মোকাদ্দেস আলী ও মুহম্মদপুর উপজেলা আমীর বাকীবিল্লাহ। র‌্যাব সূত্র জানায়, তারা দু’জনই হুজি’র স্থানীয় নেতা ও সন্ত্রাসবাদী নেতা মুফতে হান্নানের সহযোগী।
স্থানীয় পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এই দু’জনের তথ্য মুতাবিক সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর পুলিশ মুফতে ফজলুল হক আমিনী ওরফে কমিনীর নেতৃত্বাধীন (তৎকালীন) ইসলামী মোর্চার (তথাকথিত ইসলামী ঐক্যজোটের একটি শরীফ দল) মাগুরা জেলা শাখার সভাপতি ফায়জুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান এবং খেলাফত মজলিসের কর্মী সবুজ মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে সংগঠনের এই দুই নেতার গ্রেপ্তারের খবর ওই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের (শায়খুল হদস আজাযিল) মহাসচিব মালানা ইউসুফ আশ্রাফ বিবৃতি দিয়ে বলে যে, ‘কোনো প্রকার গোপন তৎপরতা ও তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে খেলাফত মজলিসের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ব্যক্তি যদি গোপনে এ ধরনের কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তা তার নিজস্ব ব্যাপার। সংগঠন এর কোনো দায়ভার গ্রহণ করবে না’।
সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও আনোয়ার চৌধুরী সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়ার উপর গ্রেনেড হামলায় সরাসরি জড়িত হুজি’র হবিগঞ্জ সদর উপজেলা সেক্রেটারি বদরুল আলম মিজান প্রকাশ্যে খেলাফত মজলিসের ছাত্রসংগঠন ছাত্র মজলিসের সঙ্গে জড়িত ছিলো। -আল ইহসান