রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনে মিয়ানমার ব্যর্থ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মিয়ানমারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা

নিউজ ডেস্ক : রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেয়ার দায়িত্ব মিয়ানমারের। এ ক্ষেত্রে কীভাবে তারা নিজেদের নাগরিকদের আস্থা অর্জন করবে সেটি তাদের বিষয়, বাংলাদেশের নয়। কিন্তু উল্টো তারা বাংলাদেশকেই দোষারোপ করছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দেশটির ওপর আরও চাপ বাড়াতে হবে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ঢাকার কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক এবং জাতিসংঘ মিশনের কর্মকর্তাদের বৃহস্পতিবার এভাবেই পরিস্থিতি ব্যাখা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন মন্ত্রী।

তবে বৈঠকে মিয়ানমারের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা বিশ্বাস করাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং রোহিঙ্গা নেতাদের আগে সেখানে নেয়ার আহ্বান জানান। এ ছাড়াও আইনলংঘনকারী এনজিওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চুক্তি রয়েছে। এ নিয়ে কয়েক দফা তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ ২২ আগস্ট কিছু লোক নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকায় রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে রাজি হয়নি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক এবং জাতীয় মিশনের কর্মকর্তাদের আমরা পরিস্থিতি ব্যাখা করেছি। বিদেশিদের বলেছি, গত ২২ আগস্ট মিয়ানমার একটি প্রেস রিলিজ দিয়েছে। সেখানে তারা পরিষ্কারভাবে আমাদের দোষারোপ (ব্লেম) করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশ লোক ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য তাদের প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু একজনও যায়নি। এটা তারা বেশ জোর দিয়ে বলেছে। এর ব্যাখায় আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলেছি, বাংলাদেশের যা করার ছিল, আমরা সবকিছু করেছি। আর মিয়ানমারের দায়িত্ব, তাদের নাগরিকদের বুঝিয়ে (কনভিন্স করে) ফেরত নেয়া। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা স্বেচ্ছায় ফিরে যায়। আর এই দায়িত্ব বাংলাদেশের নয়, মিয়ানমারের। সে ক্ষেত্রে দেশটি তাদের দায়িত্ব পালন করেনি বলেই রোহিঙ্গারা যায়নি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের দায়িত্ব হল লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া। আমরা সব ধরনের সাপোর্ট দিয়েছি। শুরুতে দেশটি আমাদের ৩ হাজার ৪৫০ জনের একটি তালিকা দিয়েছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেটি জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারকে (ইউএনএইচসিআর) দিয়েছি। এই প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার ও চীনের প্রতিনিধি সম্পৃক্ত ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলেছি, আমাদের সব ধরনের কার্যক্রম স্বচ্ছ। এখানে লুকানোর কিছু নেই। বিদেশি, স্বদেশি যে কোনো মিডিয়া চাইলে এগুলো দেখতে পারে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার বলেছে- তারা ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ করেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলেছি, তাদের নাগরিকরাইতো তাদের কথা বিশ্বাস করে না। এ ক্ষেত্রে তারা আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা মিয়ানমারকে বলেছি, তোমরা তোমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য বিশ্বের গণমাধ্যম, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং রোহিঙ্গা নেতাদের রাখাইনে নিয়ে যাও। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা নেতারা ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে। কারণ তারা নির্যাতিত। তারাই বলতে পারবে পরিবেশ নিরাপদ হয়েছে কিনা।

মন্ত্রী আরও বলেন, মিয়ানমার বারবার আমাদের নিশ্চিত করেছে, তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা এবং চলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। এ ক্ষেত্রে তাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য গণমাধ্যম এবং রোহিঙ্গা নেতাদের নিয়ে যেতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমারকে কোনো উপদেশ দিতে পারি না। কিন্তু নিজ দেশের নাগরিকদের আস্থা অর্জনের দায়িত্ব তাদের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে কোনো সময় তাদের পাঠাতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

মন্ত্রী বলেন, কূটনৈতিকদের আমরা নিশ্চিত করেছি- আমাদের পক্ষ থেকে যা করার, তা আমরা করে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে। বিশ্ব নেতাদের আরও আগ্রাসী উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। ফলে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে বাধ্য করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা নতুন কিছু চাইনি। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার যে অঙ্গীকার করেছে, সেটি বাস্তবায়নের জন্য তাদের চাপ দিতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী চীনে গিয়েছিলেন। সে সময়ে ওই দেশটির রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। এ ছাড়া দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তারা সবাই আমাদের সঙ্গে একমত যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই সমস্যার একমাত্র সমাধান। মিয়ানমার এই সমস্যা তৈরি করেছে, তাদের সমাধান করতে হবে। চীন বলেছে, তারা আমাদের সঙ্গে আছে। দুই দেশই তাদের বন্ধুরাষ্ট্র। ফলে সমস্যার সমাধানে তৃতীয়পক্ষ হিসেবে তারা কাজ করতে চেয়েছে। বুধবারও চীনের রাষ্ট্রদূত এসে সে কথাই বলে গেছেন। এরপর চীনের রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ করে সময়সূচি জানাবেন। পরবর্তীতে তিন দেশের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখা যায় কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মোমেন বলেন, অবশ্যই আস্থা রাখা যায়। কারণ বিশ্ববাসী আমাদের সঙ্গে আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছে। বিশ্বে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত তুঙ্গে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, দুই বছরে একজন মানুষও পাঠানো গেল না কেন। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায়তো জোর করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রবেশ করাতে পারবে না। কারণ এখানে নিরাপত্তা একটি ব্যাপার আছে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে। এ জন্য সমস্যার সমাধানে মিয়ানমার আমাদের কাছে আসছে। এরপর টাকা-পয়সা দিয়েও বিভিন্ন দেশ আমাদের সহায়তা করছে। ফলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। আজকের (বৃহস্পতিবারের) বৈঠকেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যাপক সাড়া দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের কাজকে সারা বিশ্ব অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের পাশে থাকবে।

তিনি বলেন, আমরা আলোচনা চালিয়ে যাব। শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধান চাই। তিনি বলেন, আগে রোহিঙ্গার সংখ্যা আড়াই লাখ ছিল। এখন ১২ লাখ। এটা একটা সমস্যা। তবে আমরা আশাবাদী, যে সমস্যার সমাধানে সফল হব।

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক মহড়া করছে- বিষয়টিকে বাংলাদেশ কীভাবে দেখছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বিষয়টি গণমাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। জনগণই মূল্যায়ন করবে, একটি গণহত্যাকারী সেনাবাহিনীর সঙ্গে কীভাবে সামরিক মহড়া করে।

মিয়ানমারের গণহত্যার বিষয়টি বিশ্ববাসীর সামনে ভালোভাবে উপস্থাপন (ফোকাক্স) হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যথেষ্ট ফোকাক্স হয়েছে। তবে আরও সামনে আসা দরকার। গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

রোহিঙ্গাদের জন্য বৈদেশিক সাহায্য কমে আসছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সাহায্য কমেনি। সব সময় সহায়তা বছরের শেষ দিকে আসে। এবারও হয়তো তাই হবে।

সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, যে সব এনজিও তাদের শর্তের বাইরে রাজনৈতিক বা উসকানিমূলক কাজ করছে, তার প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া সশস্ত্র গ্রুপ ভেতরে কাজ করছে, এ রকম কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। একটি ঘটনা ঘটেছিল, যে কিছু মানুষ দা, কুড়াল বানিয়েছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের আটক করেছি। তাদের আমরা দেশ থেকে বের করে দেব।