হারিয়ে যাচ্ছে ঐহিত্যবাহী কাসিদা

ইসলামী ডেস্ক: ক্বাসিদা আরবি শব্দ। বাংলা অর্থ ছন্দোবদ্ধ প্রশংসামূলক কবিতা। শুদ্ধ বানান ‘ক্বাসীদা’। তবে ‘কাসিদা’ এবং ‘ক্বাসিদা’ বানান দুটিও প্রচলিত। ক্বাসিদা শোনা, পড়া, ক্বাসিদা লেখা সুন্নত। যুগের পর যুগ এই সুন্নত পালনের ধারাবাহিকতায় এখন হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী সেই সুন্নতি ক্বাসিদা।

এতোদিন ক্বাসিদা পুরান ঢাকার লোকসংস্কৃতি হিসেবে টিকে ছিলো। এখনো কিছুটা চলমান আছে। যা রমজান মাসে রোজাদারদের জাগানোর জন্য ভোররাতে গাওয়া হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে পুরান ঢাকায় ক্বাসিদা গাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। নবাবী আমলে ঢাকা শহরের প্রায় প্রত্যেক মহল্লায় সর্দাররা ক্বাসিদা দলের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বিগত কয়েক বছরে এ সংস্কৃতি প্রায় লোপ পেতে বসেছে। বর্তমানে এর জায়গায় স্থান করে নিয়েছে রেডিও, টেলিভিশনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং মোবাইল অপারেটরদের সেহরি, ইফতার অ্যালার্ট সার্ভিস।

পুরান ঢাকার ক্বাসিদা উর্দু, ফার্সি, বাংলা, হিন্দি, আরবি এবং মিশ্র ভাষায় রচিত। রোজার ফযিলত, আল্লাহ্, রসূলের প্রশংসা, কেয়ামতের বর্ণনা এসব ক্বাসীদার মূল বিষয়বস্তু। সাধারণত সর্দার বা মহল্লার পঞ্চায়েতরাই এর রচিয়তা। যারা ক্বাসিদা রচনা করেন তাদের বলা হয় ক্বাসেদ। যারা ক্বাসিদার ‘কাফেলা’ বা দল পরিচালনা করেন তাদেরকে বলা হয় ‘সালারে কাফেলা’। ক্বাসিদা গাওয়ার জন্য ‘কাফেলা’ এবং ‘সালারে কাফেলা’ সারা রাতই জাগ্রত থাকেন। সেহরির সময় হওয়া মাত্রই তারা দলে দলে বেরিয়ে পড়েন অলি-গলিতে। ক্বাসিদার সুর শুনে ঘুম ভাঙে ঢাকাবাসীর। শুরু হয় আগামী দিনের রোজার প্রস্তুতি।

নবাব আহসানুল্লাহর সময়ে ক্বাসিদার ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। কারণ নওয়াব নিজেই ক্বাসিদা রচনা করতেন। তার রচিত উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘কুল্লিয়াতে শাহিন’-এ বেশ কিছু ক্বাসিদা স্থান পেয়েছে। ঢাকায় বর্তমানে উর্দু ভাষায় ক্বাসিদা গাওয়ার প্রচলন বেশি। তবে মোগল আমলে এটি গাওয়া হত ফার্সিতে। আরবি ক্বাসিদার সংখ্যা হাতে গোনা। যেগুলো এখন পুরান ঢাকাবাসী বা ‘সালারে কাফেলা’র কারোরই মুখস্থ বা সংগ্রহে নেই। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া ক্বাসিদাগুলো নিয়ে একটি সিডি তৈরি করেন ক্বাসিদাপ্রেমীরা। সেখানেও কোনো আরবি ক্বাসিদার উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

ক্বাসিদাচর্চার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো রোজার মাসে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। যা সাধারণত মহল্লার বিভিন্ন সর্দার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মরণে করা হায়। প্রতিযোগিতায় মূলত ক্বাসিদার উচ্চারণ, ব্যাকরণ, সুর, তাল, লয়, প্রভৃতি বিষয় বিচার করা হয়। ফলে বিভিন্ন আঙ্গিকে ও সংযোজনের ফলে উন্নত মানের ‘কালাম’ বা `চরণ’ রচিত হতে থাকে। কালামগুলি উর্দু ভাষায় রচিত হলেও এর মাঝে আরবি ও ফার্সি ভাষার ব্যবহারও দেখা যায়। প্রতিযোগিতার জন্য লিখিত কালামের স্বত্ত্ব ‘সালারে কাফেলা’ সংরক্ষণ করে থাকেন। একটি মজার বিষয় হল প্রতিটি ক্বাসিদার শেষ দিকের বাক্যে কোনো না কোনোভাবে রচয়িতার নাম উল্লেখ থাকে । যা রচিয়তার লেখনী শক্তির পরিচয় বহন করে।

ক্বাসিদার যেমন বেশ কয়েকটি ভাষা, এর সুরও তেমনি একাধিক। একেক ক্বাসিদা একেক সুরে গাওয়া হয়। শাহেদি, মার্সিয়া, নাত-এ রাসূল, ভৈরবী, মালকোষ প্রভৃতি রাগে এর সুর প্রয়োগ করা হয়। অধিকাংশ ক্বাসিদার সুর তৎকালীন ছায়াছবির গান থেকে নেওয়া। ক্বাসিদা মূলত কোরাস সহকারে গাওয়া হয়। যেখানে সাত থেকে আটজন তালিমপ্রাপ্ত গায়ক সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করেন। এদের মাঝে যিনি ‘সালারে কাফেলা’ তিনি সংগীত রচনা, সুর প্রয়োগ ও উপস্থাপনার পাশাপাশি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পুরান ঢাকায় পবিত্র রমজান মাসে বিভিন্ন ধরনের ক্বাসিদার উল্লেখ পাওয়া যায় :

১. চানরাতি আমাদ : পবিত্র মাহে রমজানের চাঁদ নিয়ে আসা নতুন এক আমেজের ক্বাসিদা যা ‘চানরাতি আমাদ’ নামে পরিচিত।
চাওদ উই তারিখ কা হ্যায় চান্দ ইয়ে রামাজান কা
দেখলো ইয়ে বাহাসে রাহাত হ্যায় জিসমো জানকা
পাঁচ ওয়াক্ত কা মোমেনা পড়তে রাহো হারদাম নামাজ
দেহান তুমকো হ্যায় আগার কুচ দিন কা ইমান কা…
(সময়কাল: ১৯৫০, রচনা: এজাজ ,সুর: শাহেদী, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)
অথবা,
আ গায়া এ্যায় সামোয়া মাহে মোবারক আ গায়া
ছা গায়া সারি ফিজা পার নুর বানকার ছা গায়া…
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচিয়তা: এজাজ ,সুর: কাওয়ালি, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)

২. খোশ আমদেদ : ফার্সি খুশ আমদিদ-এর শাব্দিক অর্থ সু-স্বাগতম। রমজান মাসকে আনন্দের সাথে স্বাগত জানিয়ে প্রথম পনেরো রোজা পর্যন্ত ‘খুশ আমদিদ’ গাওয়া হয়। তবে এই ক্বাসিদা ‘সদা’ এবং ‘খুশ গাওয়ালি’ নামেও পরিচিত। যেমন:
খুশ আমদিদ খোশকে লাব পার আবরে রাহমাত খোদ নিসাওয়ার হো গায়া
মারাতাবে মাহে কারামসে দেকতেহি আজ হাম…
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচিয়তাঃ মুনসেফ , কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)

৩. আলবিদা : রমজান মাসের বিদায়ের প্রাক্কালে, অর্থাৎ, ষোলো রোজার পর থেকে আফসোস ও বিরহী সুরে ‘আলবিদা’ গাওয়া হয়। যেমন:
এ্যায় মাহে মোবারাক মাহে কারাম
যানেকা আভি সামান নাহ্ কার
(সময়কাল: ১৯৫৫, রচয়িতা: এজাজ, সুর; কাওয়ালি, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)

৪. সেহরির ক্বাসিদা : রমজান মাসের সেহরির সময় রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর জন্য যে ক্বাসিদা গাওয়া হতো তা নির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতি অনুসরণে হতো না। এ ক্ষেত্রে দলীয় পরিবেশনা বা সুনির্দিষ্ট চরণও রচনা করা হতো না। বিশেষ এই ক্বাসিদা গায়কেরা ইবাদতের অংশ হিসেবে রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতেন বলে জানা যায়। এই ক্বাসিদা গায়কেরা আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করতেন না এবং ক্বাসিদার সুর প্রায়ই ছায়াছবির জনপ্রিয় গানের অনুকরণে করা হতো।
যেমন:
আল্লাহকা বান্দেকো হাম আয়ে জাগানেকো
হার দিলমে রামজানকি পায়গাম পাওচায়েঙ্গে।
(সময়কাল ১৯৫০-৫৫, রচিয়তা: আনোয়ার হোসেন, সুর; হিন্দি দার্দ ছায়াছবির গানের সুরের অনুকরণে, কণ্ঠ: আনোয়ার হোসেন)

৫. ঈদ মোবারক : ঢাকায় ঈদের পরদিন ঈদের মিছিলে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ঈদ মোবারক ক্বসিদা গাওয়া হয়। যেমন:
লুটলো এ্যায় সায়োমো মারাকানা ইল্লাল্লাহাকা
ঈদকি দিন হ্যায় পিও পায়মানা ইল্লাল্লাহাকা
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচিয়তা: মুনসেফ, সুর; কাওয়ালি, কণ্ঠ: মুহম্মদ জুম্মন মিয়া)

উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে এ পর্যন্ত অনেকেই ক্বাসিদা রচনা করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, মুনসেফ, এজাজ, হামিদ-এ-জার, হাফেজ দেহলভি, জামাল মাশরেকি, তালিব কবির, মুজিব আশরাফি, সারওয়ার, শওকত প্রমুখ। রচিয়তাদের অধিকাংশের জন্ম বিহার, পাঞ্জাব, উর্দু রোড ও হোসেনি দালানে।

পুরান ঢাকার ক্বাসিদা শুধু মাত্র ধর্মপ্রাণ রোজাদারদের আল্লাহভিত্তিক বা বিংশ শতাব্দীর রক্ষণশীল ঢাকার ধর্মীয় ও সংস্কৃতির পরিচয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে উপমহাদেশের পুরনো একটি শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যপটের অংশ। যা কোনোভাবেই বিস্মৃত হওয়া উচিত হবে না। ক্বাসিদার ভাষা, ভাষার সংমিশ্রণ, বিবর্তন, শিল্পী রচিয়তার দর্শন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সংশ্লেষণ, প্রতিযোগীদের সামাজিক পরিচিতি ইত্যাদির মাঝে লুকিয়ে আছে সেই সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরত্বপূর্ণ উপাদান।