সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা : মুনতাসির মামুন

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সাম্প্রতিক সংখ্যালঘু ইস্যু ও বিতর্ক নিয়ে দৈনিক জনকন্ঠে একটি ধারাবাহিক লিখেন। “সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা” শিরোনামে লেখাটি  ২০ জুন ২০১৬ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ৫পর্বে। তার আলোচনার মূল বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক অংশগুলোকে সংক্ষেপ করে এই প্রবন্ধটি নিউজ নাইন২৪ডটকমের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করছি।

———————————————————————————————————————

১.১  সম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা লাগানোর প্রচেষ্টা

এ প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছি। বিশেষ করে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক যখন প্ররোচনামূলক মিথ্যা বক্তব্য রাখেন তখন কিছু বলতেই হয়। প্রামাণিক বলেন-

“খুনী গ্রেফতার ও শাস্তি না হওয়ায় জনগণ বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকার ইচ্ছা করেই এই খুনীচক্রের মূল্যেৎপাটন করছে না। হিন্দু সম্প্রদায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, বাড়িঘর, মন্দির হারিয়ে, যাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠায়, তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিষয়ে কোন ভূমিকা রাখেন না।” হিন্দু মহাজোটের সুভাষ চন্দ্র সাহা বলেন, “হিন্দু নারীরা এখন নিরাপত্তার অভাবে হাতের শাঁখা খুলেও সিঁদুর মুছে চলাফেরা করেন।” [প্রথম আলো, ১৮.৬.২০১৬]

তিনি আরও কিছু কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় আসেনি। কিন্তু দু’একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, তা’হলো, তিনি বলেছেন, হিন্দু মহিলাদের এখন বোরখা পরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। শুধু তাই, নয়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পুজো অর্চনা বন্ধ হয়ে গেছে। হিন্দু মহাজোট, হিন্দু সমাজ সংস্কারক সমিতি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের অনেক নেতাই বিভিন্নভাবে এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। রানা দাশগুপ্ত নতুনভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার কথা বলেছি, রাস্তায় থেকেছি, তাদের অনেকের কাছে এ ঘটনাগুলো শুভবুদ্ধির পরিচায়ক বলে মনে হচ্ছে না। অন্তিমে তা হিন্দু সম্প্রদায়ের তো বটেই দেশেরও ক্ষতি হবে। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা নীরবে যে ক্ষমতায়ন করে যাচ্ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তাতেও অভিঘাত হানবে।

অতীতে আমরা দেখেছি, দু’একজন ব্যক্তির কারণে, তাদের উচ্চাশা এবং সে উচ্চাকাক্ষা পূরণে হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়ায় সম্প্রদায় শুধু নয় দেশের ক্ষতি হয়েছে। আমি শুধু বলতে চাই, এক রৈখিক চিন্তায় কেউ লাভবান হবেন না। এবং বর্তমানে, হিন্দু সম্প্রদায় নিয়ে যে সব বিতর্ক ওঠানো হচ্ছে তার সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই এমন চিন্তা না করা দুরূহ এবং এ রাজনীতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে যে যাবে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।হিন্দু মহিলারা বোরকা পরে চলাফেরা করেন, শাঁখা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে, পুজো হয় না এগুলো সর্বৈব মিথ্যা কথা।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের অবিলম্বে এর প্রতিবাদ জানান উচিত। না হলে, বুঝতে হবে নিজেদের উচ্চাকাক্ষা মেটানোর জন্য তারা পরিকল্পনা করছেন। যদি সেটি করে থাকেন তবে নিশ্চিত তা বাস্তবায়িত হবে না। মুরুব্বি ধরে কোন লাভ হবে না। তিনি কিছুই করতে পারবেন না।

হ্যাঁ, এসব ঘটনায় আমরা যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে ছিলাম তারা ক্ষতিগ্রস্ত হব কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সংখ্যালঘু বিশেষ করে নিম্নবর্গের সংখ্যালঘুরা। উচ্চ বর্গের সংখ্যালঘুদের তখনও কিছু হয়নি। এখনও কিছু হবে না। এ মিথ্যাচার হচ্ছে, হিন্দু সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করা, সংখ্যাগরিষ্ঠকে অপবাদ দেয়া এবং দাঙ্গা লাগানোর প্রচেষ্টা।

১.২ সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়ন এবং হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্বের ঘোষণা

ভারতের বিজেপি ঘোষণা করেছে, নির্যাতিত হয়ে ভারতে হিন্দুরা এলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এর পরপরই বাংলদেশ থেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা দিল্লী যান এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেন। লক্ষণীয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদে আজ পর্যন্ত কোন বৌদ্ধ বা খ্রীস্টান সম্পাদক হননি। তিন সম্প্রদায়ের তিনজন। তবে, পরিচিত সি আর দত্ত।মোদির সঙ্গে দেখা করতে কোন খ্রীস্টান বা বৌদ্ধ গেছেন বলে জানা যায়নি।এরই মধ্যে টার্গেট কিলিং শুরু হয়। ‘হিন্দুরা ভয়ে দেশত্যাগ করছে’ এ রকম হিড়িক তোলা হয়, রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য প্রকাশিত হয়।

এখন যেহেতু ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রশ্ন আসছে, অনেকেই তাতে সাড়া দেবেন। আমেরিকা যদি এখন নাগরিকত্ব দেয় ভিন্ন মতাবলম্বীদের এ রকম ঘোষণা দিয়ে, বাংলাদেশের অনেক বিএনপি-জামায়াত বা আটকে পড়া পাকিস্তানীরা আমেরিকা চলে যাবে সব ছেড়ে ছুড়ে।

আজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দেখছি, এখন আমরা প্রত্যেকে একে অপরকে চিহ্নিত করছি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ হিসেবে। বাঙালী পরিচয়টি এখন গৌণ। আমার মনে হয়েছে, আমাদের অধিকাংশ একটি পর্যায় পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক। একটা পর্যায়ের পর ধর্ম বিষয়টি চলেই আসে। এটি অস্বীকার করতে পারেন গায়ের জোরে, কিন্তু এটিই বাস্তব।দৈনিক জনকণ্ঠে গত ১৩ জুন স্বদেশ রায়ের লেখাটি পড়ে আবার এ বিষয়টি মনে হলো।

স্বদেশ রায়ের লেখায় একটি বক্তব্য আছে যেটি অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে তা হলো সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়ন।বর্তমানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা যে ধরনের কথা বলছেন তাতে সে ক্ষমতায়নে নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, যারা সবসময় তাদের পাশে ছিলেন তাদের অনেকেও এই সব হটকারী বক্তব্য বা অবস্থানের সঙ্গে একমত হবেন না।

সম্প্রতি রানা দাশগুপ্ত ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দুজনই বলেছেন, তারা এমন বক্তব্য দেননি। পীযূষের বক্তব্য অনেকে মেনে নিলেও রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য অধিকাংশই বিশ্বাস করেছন না।

রানা দাশগুপ্ত এখানে একটি ভুল করেছেন। তিনি পিটিআইএর খবর অস্বীকার করার পর বিবিসি পিটি আইয়ের কাছে জানতে চায় বিষয়টি সম্পর্কে। পিটি আই বিবিসিকে জানিয়েছে তাদের রিপোর্টিং সঠিক। জাতীয় একটি সংস্থা যখন এ বক্তব্য দেয় তখন বুঝতে হবে তাদের কাছে রেকর্ড আছে দেখেই তারা এভাবে বলতে পারে।

স্বদেশ রায় তার লেখায় জানিয়েছেন, রানা দাশগুপ্ত মোদির সাহায্য চেয়েছেন। তার এবং আরও অনেকের বিশ্বাসের কারণ, রানা দাশগুপ্ত আগে এত মারাত্মক না হোক, কাছাকাছি অনেক মন্তব্য করেছেন।

অন্যদিকে এটিও বিবেচ্য, মোদি সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সুসম্পর্ক থাকার পরও যখন মোদি গোপনে তাদের আমন্ত্রণ জানান ও তারা গোপনে যান সেটি শেখ হাসিনা বা সরকারের পক্ষে খুব সম্মানজনক নয়। রানা দাশগুপ্ত তো এখন সরকারী কর্মকর্তা, সরকারী নিরাপত্তায় রক্ষিত, তিনি কি সরকারের অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন যে এ ধরনের এক গোপন প্রতিনিধিদল নিয়ে তিনি যাচ্ছেন। এ ঘটনা কিছুটা হলেও দু’দেশের সম্পর্কে অভিঘাত সৃষ্টি করবে।

এ কথা বলার পরও বলব রানা বা পীযূষের [তারা অস্বীকার করেছেন] ঐ ধরনের মন্তব্য করার অধিকার আছে। কিন্তু স্বদেশ রায় যে মূল প্রশ্নটি করেছেন, ‘সম্প্রদায়ের নামে বিভেদ ছড়ানো’ সেটিই মৌল বিষয়। পরিস্থিতি এত বিষাক্ত, বিস্বাদ ও অনিরাপদ হলে রানা দাশগুপ্ত বা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আজ যে অবস্থানে আছেন সে অবস্থানে থাকতে পারতেন না, আসতেও পারতেন না।

১.৩ ভারতকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করা নিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ

একটি কথা বলে নেয়া ভাল। সংখ্যালঘিষ্ঠরা সব দেশেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে ঘৃণা করা হয়। গত শতকের আশির দশকে আমি অভিজ্ঞতা (লন্ডনে থাকাকালীন যখন বর্ণবাদী আক্রমণ বেঁড়ে গিয়েছিল)  দিয়ে এই জ্ঞান অর্জন করি। পরে বিষয়টা অনুধাবন করলাম, তারা (অন্যান্য বাঙালীরা) লন্ডনে থাকতে এসেছেন, যেতে নয়। আমি থাকতে আসিনি, চলে যাব। দুটোর মধ্যে অনেক তফাত। যিনি থাকতে এসেছেন, তাকে কিছুই স্পর্শ করছে না। আতঙ্কিতও হচ্ছেন না, প্রয়োজনে বিবাদ এড়িয়ে চলেন, পারলে প্রতিরোধ করেন।

আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ বিশেষ করে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের, তাহলো ভারতকে হিন্দুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় মনে করা। বিয়ে সম্পত্তি সব কিছুর জন্য তারা ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনেকে এখানে থাকেন, ছেলেমেয়ে বহুদিন থেকে ভারতে থাকে, সহায় সম্পত্তিও করেছেন। যদি নাম বলতে বলেন, সেগুলো বলা যেতে পারে। দু’নৌকাই পা রাখেন।

এ কথাগুলো এতদিন ওঠেনি, এখন উঠবে যেটি আমরা চাইনি।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অন্যদেশে সহায় সম্পত্তি করা কি অন্যায়? চলে যাওয়া? না এখন সবাই বিশ্ব নাগরিক। মুসলমানরা কি দেশত্যাগ করছেন না? অবশ্যই করছেন, সহায় সম্পত্তিও করছেন। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের একটি বিরাট অংশের স্ত্রী পুত্র কানাডায় থাকে, নিজে এখানে শোষণ চুরি-চামারি, সরকারী আনুকূল্যে যা পান ভোগ করে বাকীটা বাইরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু, পার্থক্যটা হলো, ধর্ম নিয়ে এসব সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিচলিত নন। তারা সৌদি আরব, ইয়েমেন, পাকিস্তান যান না। তারা যান ইউরোপ আমেরিকা।

আমাদের দেশের হিন্দুরা ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতমুখী হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন এবং শুধু ধর্মীয় কারণে। সংখ্যা গরিষ্ঠের যারা যান, তারা ফিরে আসেন। মাঝে মাঝে আসেন এবং এ নিয়ে লুকোচুরি নেই। এখানকার হিন্দুরা গেলে আর আসেন না। ধর্মটাই বেশি প্রাধান্য পায়।

অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে [পাঞ্জাবের কথা বাদ দিলে] ভারত থেকে মুসলমান খুব একটা আসেনি। এখন তো আসেনই না।তারা কি বাংলাদেশের হিন্দুদের থেকে সেখানে ভাল আছেন? মোটেই না। অনেক ক্ষেত্রে খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন। তবুও ‘মুসলমানদের দেশ’ বাংলাদেশে আসেন না কেননা, তারা ভারতকেই দেশ মনে করেন। তারা বাংলাদেশে সহায় সম্পত্তিও করেন না, ছেলেমেয়েও পাঠিয়ে দেন না।

পার্থক্যটা কেন হচ্ছে, সেটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের বুঝতে হবে। আমার এ বক্তব্যে তারা অসন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু, এটি যে বড় সত্য সেটি অস্বীকার করতে পারবেন না। তাদের মানস জগতে এটি প্রভাব বিস্তার করে আছে যে, ভারত হিন্দু রাষ্ট্র, ভারতই হিন্দুদের সহায়তা করবে। করবে কি? করেছে কি আগে?

ভারত নিজ স্বার্থে চলবে। হিন্দু কার্ড খেলা যদি তার কাছে স্বার্থোদ্ধারে উত্তম মনে হয় তাহলে সেটি খেলবে। যদি উত্তম মনে না হয় খেলবে না। ইসরাইল যেমনটি করে। সুতরাং ‘হিন্দু’ হলেই ‘হিন্দু ভারত’ এগিয়ে আসবে তা নয়।

যারা দেশত্যাগ করছেন তারা শুধু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন দেখে যাচ্ছেন না, আত্মীয়তা থেকে শুরু করে নানা কারণে যাচ্ছেন। যাদের আত্মীয়দের বড় অংশ ভারতে তারা একসময় তো দেশত্যাগ করবেনই।

স্বদেশ লিখেছেন, যেটি বাস্তব সত্য কিন্তু যা আমরা বলি না চক্ষুলজ্জায় তাহলো “তাছাড়া একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, নেতৃত্বে যারা আছেন এরা হয়ত কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন কিন্তু দেশের দেড় কোটি হিন্দুর এক কোটি ২৫ লাখের সে সমর্থ নেই। তাদের ভারতে গেলে থাকতে হবে রেল লাইনের ধারের বস্তিতে না হয় পাড়ি দিতে হবে আন্দামানে। এই ভুল আর নয়। ৪৭ থেকে নেতাদের এই পলাতক মনোভাবের কারণে অনেক ভুল হয়ে গেছে। এখন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। বিশ্ব একক হতে চলেছে। এ সময়ে বিশ্ব নাগরিক হোন কিন্তু রিফিউজি হওয়ার জন্য কোন রাজনীতি করা ঠিক নয়। তাছাড়া এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে শেষ অবধি অনেক ক্ষতি হয় কমিউনিটির।”

১.৪ দেশ ত্যাগ, জমি দখল ও টার্গেট কিলিং  

কারা বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন? হিন্দু সম্প্রদায়ের, সব পর্যায় থেকেই। আমাদের চোখে নিম্নবর্গের সংখ্যাটি বেশি চোখে পড়ে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় মধ্যবিত্ত হিন্দুরা প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের হিন্দু মসুলমান বঙ্গভঙ্গ চেয়েছেন। তারা পূর্ববঙ্গের উন্নতি চেয়েছেন। এ সূত্রটিই ছিল আমাদের জীবনচর্যার প্রধান সূত্র। উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় দেখি, সবসময় হিন্দু-মসুলমান এ ভূখন্ডটির ওপরই জোর দিয়েছেন। এ মনোভাব নানা টানাপোড়েনেও ছিন্ন হয়নি।

হিন্দু নেতারা এখন যা বলছেন, বা সংখ্যাগরিষ্ঠের অনেকে হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে যে ধারণা সেটিও সম্পূর্ণ ঠিক নয়। তবে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, যা আগে উল্লেখ করেছি। সব দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘুকে যেমন হুমকিতে রাখে তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠের অনেকে সেই হুমকি প্রতিরোধে এগিয়েও আসে। সেটি ভুলে গেলে অন্যায় হবে।

বাঙালী হিসেবেই আমরা দেশটি স্বাধীন করেছিলাম। হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়নি। সেই প্রশ্ন বড় করে দেখা দিয়েছিল বা সৃষ্টি করা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমল থেকে। স্টান্টবাজ এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে সেই পার্থক্যটি বড় করতে চেয়েছিলেন।

খালেদা জিয়া ও নিজামী-খালেদা জিয়ার আমলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হিন্দুদের টার্গেট করা হয়।তাদের বিভিন্ন হামলার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা  এবং হিন্দু নেতৃবর্গও বলেছেন যে,

হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, সুতরাং, তাদের তাড়াতে পারলে বা ভোট দেয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারলে আওয়ামী লীগের ভোট কমে যাবে। দুই, জমিজমা দখল করা যাবে। তিন, হিন্দু-মুসলমান ফারাক সৃষ্টি করা যাবে। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করতেন। কিন্তু, বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। এ চিন্তা একরৈখিক। প্রচুর হিন্দু এখন আওয়ামী লীগে ভোট দেন না। বিএনপিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে আছেন।

নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের জমিজমা কী এমন বেশি আছে? জমিজমা কি শুধু হিন্দুদেরই দখল হচ্ছে? মুসলমানদের কী পরিমাণ জমি দখল হচ্ছে?নির্বাচনের সময়, হিন্দু কেন, আওয়ামী লীগ সমর্থক মুসলমানরাও বিতাড়িত হয়েছেন।সাম্প্রতিক ইউপি নির্বাচনে সারাদেশে প্রায় ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে হিন্দু কয়জন? সবই মুসলমান এবং অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুতরাং, প্রচলিত সব ধারণা সত্য নয়।

অনেক হিন্দু নেতা বলেছেন, ১৯৭১ সালের মতো এখনও হিন্দু টার্গেট করা হচ্ছে, গণহত্যা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত আপত্তিজনক কথা।তারা বলছেন, রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এ কারণে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করছেন। এ যুক্তিতো অস্বীকার করি না। ধর্ম অনুসারেও সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। কেননা তারা আমানত। রসুল (দ.) নিজে তা মেনেছেন। কিন্তু প্রাক ২০১৪ এবং ২০১৪ পরবর্তী সময়ে ভায়োলেন্সে কতজন হিন্দু মারা গেছেন? যদি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ই টার্গেট হতেন তাহলে এতো মুসলমান, নিরাপত্তা বাহিনীর এতো মুসলমান কেন মারা গেলেন? বাড়িঘর তাদের কতগুলো পুড়েছে? হ্যা, হিন্দুদের পুড়েছে। অন্যদেরও পুড়েছে।

২০১২ থেকে এ পর্যন্ত মন্দির আক্রান্ত হয়েছে, হিন্দু এলাকায় আক্রমণ হয়েছে এ সবই সত্য। কিন্তু, আমরা যদি শুধু একরৈখিকভাবে তা দেখি তবে তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। এদের পাশে সব সময় দাঁড়িয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন, ১৪ দল, নাগরিক সমাজ। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান পরিষদ বিবৃতি ছাড়া আর কতটুকু সাহায্য করেছেন? প্রতিটি ঘটনার পর আর কেউ না থাক নির্মূল কমিটির নেতৃবর্গ গিয়েছেন। এবং এটা সত্য সংখ্যাগরিষ্ঠরা যেখানে মার খেয়েছেন সেখানে তারা তেমন যাননি।

১.৫ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ এবং ভারতীয় হাইকমিশনের ভূমিকা

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনে আপত্তির কিছু নেই। আপত্তিটা হলো তারা মনে করিয়ে দিলেন, আবারও বিষয়টা বাঙালী বনাম পাকিস্তানের নয় এটি ইসলাম বনাম অন্য ধর্মের। এখন আলাদা নির্বাচন, কমিশন ইত্যাদি গঠনের দাবিও জানানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে আবার পাকিস্তানী আমলেই ফিরে যাচ্ছি। এতে তারা লাভবান হয়েছেন বলে আমার মনে হয় না, বরং তারা নিজ সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করেছেন। তারা যদি বাঙালিত্বের ওপর জোর দিতেন ধর্মের ওপর নয় তাহলে এ প্রশ্নগুলো জাগত না।

হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা শুধু নয়, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও যে ভূমিকা পালন করছেন তাও খুব যথার্থ বলে অনেকে মনে করেন না। হিন্দু পুরোহিত হত্যা হলে তিনি সমবেদনা জানাতে যাচ্ছেন। অন্যরা হলে তা নয় কেন? শাহরিয়ার কবিরই এ প্রশ্ন তুলেছেন। ভিন্ন জীবন ধারার সমর্থককে হত্যা করা হচ্ছে। যেমন জুলহাস। মিতুর যে ছবি ছাপা হয়েছে তাতে বোঝা যায় খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন তিনি। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত সেখানে যাননি। জুলহাসের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। এসব কিছুর মধ্যে মতলববাজি আছে। এসব কিছুই সমাজে রাষ্ট্রে বিভিন্নতা ছড়াচ্ছে, সন্দেহ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে।

আমাদের মিডিয়াও বিভিন্নতা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখছে। ‘আদিবাসী তরুণী ধর্ষিত’, ‘হিন্দু বালিকা ধর্ষিত’, ‘সংখ্যালঘুর জমি দখল’- এ ধরনের শিরোনাম দেখলে যে কারও ধারণা হবে বাংলাদেশে বেছে বেছে শুধু এ ধরনের কর্মকান্ড চালানো হয়। মুসলমান তরুণী কি ধর্ষিত হচ্ছেন না বা খুন হচ্ছেন না বা তাদের জমি দখল করা হচ্ছে না। কিন্তু সেভাবে শিরোনাম হয় না।

এতে সমাজে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হয়। যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে তাদের কাছে ধর্মবোধগুরুত্বহীন। তারা বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তা করছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা মতাদর্শের সবাই তাদের টার্গেট। এটি ভুললে চলবে না।

১.৬ রাষ্ট্রধর্ম ও সেকুলারিজম

হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ শুধু নয়, আমরাও বারবার বলেছি, রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে চার মূলনীতির একটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, এটা সাংঘর্ষিক। এটি কঠিন সত্য ও তাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু বাস্তবে কি শেখ হাসিনার পক্ষে সম্ভব এটি বাদ দেয়া? বাদ দিলে, সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত তো বটেই, ইসলাম-পছন্দ মানুষ সব এক হবে। শুধু তাই নয়, গ্রামাঞ্চলের মানুষজনের মধ্যেও এ বিশ্বাস পোক্ত হবে যে, বর্তমান সরকার ধর্মবিরোধী সরকার। যেখানে ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ঐক্যপরিষদ গঠিত হয় সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্ট কী হবে সেটিও বিবেচ্য।

ভারত তো সংবিধান অনুযায়ী সেক্যুলার রাষ্ট্র। সরকারী নীতি কি তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? ফ্রিজে গো মাংস রাখা হয়েছে এ গুজবে মুসলমান পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। পৃথিবীর কোন দেশে সরকার নীতি প্রণয়ন করেননি কে কি খেতে পারবে কি পারবে না। এমন কী যে বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে এত অভিযোগ যার জন্য নরেন্দ্র মোদির কাছে ধর্ণা দিতে হয় সেখানেও এই নীতি নেই।

কূটতর্ক, তত্ত্ব সব মেনে নিলেও বাস্তব এই যে, ধর্মের আঁচ মানুষের গায়ে কোন না কোনভাবে থাকবেই। রেনেসাঁ থেকে এই ধারণার উৎপত্তি যে, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে হবে। সেটি কতটা সম্ভব হয়েছে, এমনকি ‘সেক্যুলার’ হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রে সেটিও এখন ভেবে দেখা দরকার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বাস্তবে সেটিই ছিল বাঙালীর ধর্মবোধ। তিনি বলেছিলেন,

‘বাংলাদেশ হবে-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’

ইতিহাসের সত্য হলো, বাংলাদেশ কখনও সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদের দেশ হয়ে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ কখনও সম্পূর্ণভাবে হিন্দুদের দেশ হয়ে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে একমাত্র বাঙালীর রাষ্ট্র হিসেবেই। বাঙালী মানসও তা-ই বলে।

সংকলন: মূলধারা বাংলাদেশ