মেট্রোরেল কি ঢাকার উন্নয়ন ডেকে আনবে, না ধ্বংস?

মীর আহসান: রাজধানীর অসহনীয় যানজট সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি বর্তমান সরকারসহ বিগত সরকারেরাও। বর্তমানে ঢাকাকে এখন চলাচলের অনুপোযুক্ত নগরী বলা হয়। বিশেষ করে যানজট সমস্যার সমাধানের নামে ঢাকার মহাসড়ক চিড়ে একের পর এক যেভাবে উড়াল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে এতে ঢাকার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। অপরদিকে যানজটের কোন সমাধান হচ্ছে না এতে। প্রতিটা উড়াল সেতুর উপর যানজট লেগেই থাকে। বলা যায় একটি মোড়ের যানজট বিভক্ত হয়ে ৪/৫ জায়গায় ছড়িয়ে সে জায়গাগুলোতেও যানজট সৃষ্টি করছে। উদাহরণস্বরূপ- যাত্রাবাড়ির যানজট ছড়িয়ে পড়েছে গুলিস্তানে, গোলাপবাগে, চাঙ্খারপুলে। এসব জায়গায় যখন গাড়িগুলো নামে তখন সেখানে আরেকটি যানজট সৃষ্টি হয়। তারমানে যাত্রাবাড়ির উপর চাপ কমলেও সেই চাপ গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আরো কয়েকটি এলাকায়। আর যাত্রাবাড়ির যানজট কিন্তু কমেনি। বরং সায়দাবাদ বাস টার্মিনালের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে।

রাজধানীর এতোগুলো ফ্লাইওভারে যেখানে সুষ্ঠ সমাধান হচ্ছে না, সেখানে আবার উত্তরা থেকে যদি মতিঝল পর্যন্ত রাস্তা কেটে মেট্রেরেল করার কাজ শুরু হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদী প্রকৃয়াসম্পন্ন এসব কর্মযজ্ঞে (মূলত ধ্বংসযজ্ঞ) রাজধানীবাসী যতোটা ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে এবং মূল্যবান কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে তা পৃথিবীতে বিরল। এরই মধ্যে যদি মেট্রোরেলের কর্মযজ্ঞ শুরু হয় তবে ঢাকা থেকে সকলের পালিয়ে যাওয়াই উত্তম হবে।

একটা মেট্রোরেল কেন ? এ ধরনের ৫০টা রেল আর ফ্লাইওভার বানালেও ঢাকা শহরে যানজট কমবে না। যেমনটি যানজট কমেনি যাত্রাবাড়িতে, যানজট কমেনি মহাখালীতে, কমেনি খিলগাঁও ফ্লাইওভারেও।

যানজট নিরসনের একমাত্র উপায় হচ্ছে ঢাকাকে বিকেন্দ্রকরণ। যে ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেট্রোরেল বানানো হচ্ছে সেটা দিয়ে ২৭টা জেলায় ১ হাজার কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করলে ২৭টি শহর ঢাকার মতো পরিপূর্ণ শহরে রূপান্তর করা সম্ভব। এভাবে প্রতিটি জেলা শহরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে উন্নত করলে কোন মানুষকে আর নিজ জেলা, পরিবার পরিজন ছেড়ে ঢাকা আসতে হবেনা। তাহলে যেখা যাবে ক্যারিশমেটিকভাবে ঢাকার যানজট কমে গেছে। 

কিন্তু সেটা না করে সারা দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা কেবল ঢাকায় ঢেলে দেয়া হচ্ছে। বাকি ৬৩টি জেলাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে উন্নয়ন থেকে। বিষয়টি অনেকটা পশ্চিম পাকিস্তান ও পুর্বপাকিস্তানের মত। যেমন ১৯৭১ এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের সব টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন করা হতো, ঠিক তেমনি বর্তমানে ৬৩ জেলার টাকা দিয়ে শুধু ঢাকাকেই উন্নত করা হচ্ছে। বঞ্চিত করা হচ্ছে বাকি জেলা শহরগুলোকে।

এখন বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটা হলো- অনুৎপাদনশীল খাতে যেমন- মেট্রোরেল, সেতু, ফ্লাইওভার, ১৪২ তলা ভবন, বিমানবন্দর করা ইত্যাদিতে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। অর্থাৎ দেশের মূল টাকা ইট-বালু সিমেন্ট, কাঠামোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে উৎপাদনশীল খাত যেমন: কৃষি, কলকারাখানা বৃদ্ধি, কৃষকের ভূর্তুকী, অচল হয়ে পড়া কারখানাগুলোকে সচল করা, স্বস্তায় তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ দিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন অন্ধকারে পড়ে আছে। ফলে দেশের সামগ্রীক উন্নয়ন হচ্ছেনা। আগামীতে হওয়ার সম্ভবনা দেখা যাচ্ছেনা।

প্রসঙ্গত, এবারের (২০১৬-১৭) অর্থবছরের বাজেটেও গণউন্নয়নমূলক কোন কিছু নেই। বরং অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকদের ট্যাক্স দিতে হবে। জনগণের আয়কর আরেকটু বাড়িয়ে দিলে মন্দ হয়না। আখ চাষ বন্ধ করে দিয়ে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিদেশে গিয়ে বলেছেন, আমরা কৃষি থেকে শিল্পের দিকে যাচ্ছি। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি হচ্ছে কৃষিনির্ভর। এদেশের ৮৫হাজার গ্রামের মানুষ জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম হচ্ছে কৃষি। তাহলে কৃষি থেকে শিল্পের দিকে গেলে  এই ৮৫ হাজার গ্রামের মানুষ কি কাজ করবে? কি খাবে? কিভাবে বাঁচবে?

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এটা স্পষ্ট গণবিরোধী উন্নয়ন(!)। এই কথিত উন্নয়ন আসলে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নয়। বরং ভিন্ন কোন গোষ্ঠীর জন্য।

প্রকৃতপক্ষে দেশের প্রতিটা নাগরিক যখন স্বচ্ছলভাবে, নিশ্চিন্তে-নির্বিঘ্নে, সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে তখনই সেটাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যাবে।

লেখক: গবেষক ও লেখক