মরণ বাঁধ ফারাক্কা: নদীগুলো পানিশূন্য, বদলে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানচিত্র

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ফারাক্কার বাঁধ বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগুচ্ছে জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাঁধের কারণে একদিকে প্রমত্তা পদ্মা ও মহানন্দা যেমন নাব্যতা হারিয়েছে। তেমনি দেড় যুগ ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক নদী ভাঙন চলছে। একসময়ের ভয়াল পদ্মা এখন পানিশূন্য। এসব কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। বাংলাদেশ যে একদিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, আজ থেকে ৪১ বছর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ফারাক্কার ক্ষতির কথা চিন্তা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধবিরোধী আন্দোলন নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে এসেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের ঠুঠাপাড়াগ্রাম। এই এলাকা দিয়েই প্রমত্তা পদ্মা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ওপারে ভারতের মালদহ জেলার আরঙ্গাবাদ ও শোভাপুর এলাকা। বাংলাদেশের ঠুঠাপাড়া পয়েন্ট থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। সন্ধ্যার পর নদীপাড়ে দাঁড়ালে ফারাক্কা বাঁধের ঝলমলে আলো অনায়াসেই দেখা যায় বলে জানান স্থানীয়রা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের এত কাছাকাছি এসেও পদ্মা নদীতে তেমন একটা পানি দেখা গেল না। নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বালুচর। অনেকটা দূরে জীর্ণশীর্ণ পদ্মার স্রোতহীন পানিপ্রবাহ দেখা যায়। সরেজমিন এই এলাকা ঘুরে স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছ থেকে শোনা গেল ফারাক্কার সর্বনাশী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা। ঠুঠাপাড়ার কৃষক মকবুল হোসেন জানান, শুষ্ক মৌসুমে এখানে এলে বোঝায় যায় না এখানে কোনো নদী আছে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বছরের ৬ মাস পদ্মায় কোনো পানি থাকে না। চারিদিকে ধু ধু বালুচর।

তিনি জানান, তার পূর্ব পুরুষদের কাছে গল্প শোনা পদ্মার ভয়াল রূপ আর এখন দেখা যায় না। নদীর উজানে ভারত বাঁধ দেয়ায় নদীর এমন করুণ রূপ বলে তিনি জানান। এর প্রভাবে আপনাদের তেমন কি ক্ষতি হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পানির অভাবে নদীর পাশে থাকা সত্ত্বেও আমাদের জমিতে সেচ দেয়ার জন্য মাটির নিচ থেকে পানি তুলতে হচ্ছে। তার কথার সত্যতা মেলে নদী-তীরবর্তী বিশাল মাঠ দেখে। বিভিন্ন ফসলের আবাদ হচ্ছে এইসব মাঠে। কিছু দূর পরপরই ছোট ছোট চাটাইয়ের ঘর। এসব ঘরে নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে তোলা পানি দিয়েই আবাদ করা হয় বলে স্থানীয়রা জানান। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচের পানি পেতে কৃষকদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না।

ফরাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার চিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অঞ্চলজুড়ে। গত দেড় যুগ ধরে সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে ভয়াবহ নদী ভাঙন। এই দুই উপজেলার নারায়ণপুর, সুন্দরপুর, পাকা ও উজিরপুর এই চার ইউনিয়ন পুরোটায় বিলীন হয়ে গেছে নদী গর্ভে। এছাড়াও দেবীনগর, আলাতুলি, শাহজাহানপুর, ইসলামপুর, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নেও অব্যাহত রয়েছে নদী ভাঙন। এসব ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ভূমিহীন এ মানুষগুলোর করুণ আর্তনাদে প্রায় প্রতিদিনই শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয় পদ্মাপাড়ের গ্রামগুলোতে।

ফারাক্কার কারণে পরিবেশের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে হস্তচালিত নুলকূপে পানি উঠছে না। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য মতে, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ২৫ হাজার হস্তচালিত নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুরুল হুদা জানান, ফারাক্কার কারণে অতিরিক্ত খরাপ্রবণ হয়ে উঠেছে জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষি।

বদলে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানচিত্র:

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে ভারতে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এই অঞ্চল অনেকটা মরুভূমিতে পরিণত হয়। আবার বর্ষায় ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে হঠাৎ ফুঁসে উঠা পদ্মা ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাড়িঘর, ফসলসহ সবকিছু। আর অব্যাহত ভাঙনে বসতভিটা, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে জেলার মানচিত্র।

ভারত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা। ১৯৭৫ সালে এখান থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে এই নদীর গতিপথ। এক সময় সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই নদী ক্রমেই ভাঙ্গতে থাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলি, চরবাগডাঙ্গা, নারায়নপুর, পাকা, উজিরপুর ও দেবিনগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

ভাঙ্গন কবলিত এসব এলাকা পরিণত হয় ধুধু বালুচরে। নিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের কারণে একাধিক চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে পড়ে পদ্মা। যা এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। পদ্মা এখন এই অঞ্চলের মানুষের অনেকটা অভিশাপ। জায়গা-জমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হাজার হাজার পরিবার। ফারাক্কার কারণে জেলার অন্যান্য নদীগুলোতেও এর প্রভাব পড়ার পাশাপাশি পদ্মা নদীকে নির্দিষ্ট চ্যানেলে ধরে রাখা যাচ্ছেনা বলে জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম। পাংখা পয়েন্টে থেকে শুরু করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পর্যন্ত চাঁপাইনাবগঞ্জ অংশে পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। পদ্মাপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকায় ৬টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে।