সারা মুসলিম বিশ্বে শামসী ক্যালেন্ডারের প্রচলন ও প্রচারের আহবান মাজলিসু রুইয়াতিল হিলালের

ডেস্ক: “আত তাকউইমুশ শামসী” নামে মুসলিম রচিত পূর্ণাঙ্গ ও প্রথম ইসলামী সৌর ক্যলেন্ডার প্রকাশিত হয়েছে। আজ শনিবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সেমিনারে আয়োজকগণ এই সৌরসনের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেন।

ঢাকা রাজারবাগ দরবার শরীফের পক্ষ থেকে ‘সর্বপ্রথম মুসলিম রচিত ইসলামী সৌর ক্যলেন্ডার আত তাকউইমুশ শামসী’ শীর্ষক এই সেমিনারে আয়োজন করেন ‘মাজলিসু রুইয়াতিল হিলাল’ নামক একটি আন্তর্জাতিক চাঁদ দেখা ও মহাকাশ গবেষক কমিটি।

সেমিনারে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, রুইয়াতিল হিলাল মজলিসের প্রধান গবেষক, বিশিষ্ট চাঁদ ও মহাকাশ গবেষক এবিএম রুহুল হাসান। এছাড়া ইসলামের আলোকে সৌর বা শামসী সনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মুফতিয়ে আ’যম আল্লামা আবুল খায়ের মুহম্মদ আযীযুল্লাহ।

“আত তাকউইমুশ শামসী” সনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বক্তারা বলেন, এর আগে প্রবর্তিত সকল ক্যালেন্ডার ছিল লুনি-সোলার সমন্বিত ক্যালেন্ডার। মুসলিম প্রবর্তিত সর্বপ্রথম ও একমাত্র এই সোলার বা সৌর ক্যালেন্ডারের সন গণনা শুরু হয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বছর এবং যে মাসে আল্লাহ পাকের সাথে দীদারে মিলিত হন সেই বছর ও সেই মাসের পহেলা তারিখ অর্থাৎ পহেলা রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরী থেকে। তাই “আত তাকউইমুশ শামসী” অনুসরণ করা সকল মুসলমানদের জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। পাশাপাশি বাংলদেশ সরকারসহ মুসলিম বিশ্বের উচিত সারা মুসলিম বিশ্বে এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন করা।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, মহান আল্লাহপাক পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ করেছেন “তিনি সূর্যকে করেছেন তেজোদীপ্ত, আর চাঁদকে করেছেন আলোকময় আর তার (হ্রাস বৃদ্ধির) মানযিলসমূহ সঠিকভাবে নির্ধারণ করেছেন, যাতে তোমরা বৎসর গুণে (সময়ের) হিসাব রাখতে পার। আল্লাহ এটা অনর্থক সৃষ্টি করেননি, তিনি নিদর্শনগুলোকে বিশদভাবে বর্ণনা করেন জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য।” (সূরা ইউনুস শরীফ, আয়াত শরীফ ৫)।

এথেকে বোঝা যায়, মুসলমানদের চাঁদের ক্যালেন্ডারের (হিজরি ক্যালেন্ডার) পাশাপাশি প্রয়োজন একটি সূর্য ভিত্তিক রচিত সৌরসাল। বর্তমানে ইরান ও আফগানিস্থানে লুনি-সোলার (চাঁদ ও সূর্যের সমন্বয়ে) ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হলেও মুসলমানদের রচিত পূর্ণাঙ্গ সৌরসাল কোন মুসলমান দেশেই প্রচলিত নেই। তাই ঈসায়ী ক্যালেন্ডার যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে নতুন সৌরসন “আত তাকউইমুশ শামসী” বাংলাদেশ সহ সারা মুসলিম বিশ্বে প্রচলন খুবই জরুরী।

বক্তারা আরো বলেন, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে গড়ে এক বছর সমান ধরা হত ৩৬৫.২৫ দিন কিন্তু বাস্তবে এক সৌর বছর সমান হল ৩৬৫.২৪২২ দিন। ৩২৫ ঈসায়ী সনে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ২১ মার্চ, দিন-রাত সমান ঘোষণা দেয়ার পর থেকে প্রতি বছর ১১ মিনিট করে পার্থক্য হতে হতে ১৫৮২ সালে এই পার্থক্য এসে দাঁড়ায় প্রায় ১০ দিন। এই পার্থক্যের কারণে ২১ শে মার্চের পরে পূর্ণ জোছনা (Full Moon) অনুযায়ী ঈস্টার ডে পালনের তারিখটি সরে আসতে থাকে। সে কারণে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এটি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহন করে এবং ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর পরিবর্তিত হয়ে ঘোষিত হয় ১৫ অক্টোবর ১৫৮২ সাল। অর্থাৎ এই সংশোধনের মূল কারণটিই ছিল ধর্মীয়। তারপরেও কেবল ধর্মীয় কারণে ৩০০ বছর নন-ক্যাথলিক সম্প্রদায় এটি অনুসরণ করেনি। এমনকি রাশিয়া ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর ঈসায়ী ক্যালেন্ডার চালু করে, আর গ্রীস চালু করে ১৯২৩ সালে এবং সবশেষে তুরস্ক চালু করে ১৯২৬ সালে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে প্রথম ইউরোপীয়রাই অনুসরণ করে বলে, এটা ইউরোপীয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে খ্যাত।

বক্তারা বলেন, বর্তমানে ইরান, আফগানিস্থান, ইথিওপিয়া, নেপাল তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার ব্যবহার করছে। উল্লেখ্য এদেশগুলো কখনো ইউরোপীয় উপনিবেশ মেনে নেয়নি। ভারত উপমহাদেশে বৃটিশরা প্রথম ১৭৫৭ সালের দিকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে আসে। মূলত এটি আমাদের কোন ক্যালেন্ডার নয় বরং জোর করে চাপিয়ে দেয়া একটি সৌরসাল। তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, জাপান নিজেদের মত করে একটা ক্যালেন্ডার ব্যবহার করছে। তাছাড়া ভারত, ইসরাইল, চাইনিজরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায়িক কারণে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে নিলেও নিজ নিজ দেশের প্রশাসনিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাজকর্ম পালনের লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকে। ভারতে ইউরোপীয় উপনিবেশ থাকার কারণে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে সত্য, কিন্তু এখনো অনেক প্রদেশের প্রশাসনিক কাজ থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাজসমূহ তাদের স্ব স্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পালিত হচ্ছে। বক্তাদের দাবী, এই দেশগুলো কেবল তাদের ধর্মীয় উৎসবের তারিখ নির্দিষ্ট করার জন্যই নয় বরং জাতিগত সত্ত্বা বজায় রাখার জন্যেও যার যার নিজস্ব ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকে। তাহলে সারাবিশ্বের মুসলমানরা কেন তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য মুসলমান রচিত “আত তাকউইমুশ শামসী” সন ব্যবহার করবে না?

বক্তারা বলেন, পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্যালেন্ডারের মধ্যে একটি হচ্ছে, ইরানী ক্যালেন্ডার যা জালালী ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। ইরানের সর্বশেষ রাজা, রেজা শাহ পাহলভি ১৯৭৬ সালে বর্ষপঞ্জীর হিসাব পদ্ধতিতে সামান্য পরিবর্তন এনে এর প্রথম সালকে প্রায় ১২০০ বছর আগে নিয়ে হিসাব করার আদেশ জারী করেছিলো, কারণ সেই সালটিকে ধরা হয় ইরানের শাসক সাইরাসের ক্ষমতায় আরোহণের বছর হিসেবে। তাহলে দেখা গেল, শাসকদের স্মরণ করার জন্যেও বর্ষপঞ্জিকে শাসক শ্রেণী বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে।

বক্তারা বলেন, এই শামসী সন শুরু হয়েছে, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে বছর এবং যে মাসে মহান আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে চলে গেলেন, সেই বছর ও সেই মাসের পহেলা তারিখ থেকে। অর্থাৎ ১১ হিজরি সনের পবিত্র রবীউল আউয়াল মাসের পহেলা তারিখ থেকে। এই শামসী সন অনুসরণের মধ্যে দিয়ে মুসলমানগণ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনাকে স্মরণ করবেন। সে হিসেবে এখন ১৩৮৬ শামসী সন চলমান রয়েছে।

সেমিনারে আলোচকবৃন্দ বলেন, মহান আল্লাহ পাক বলেন “তোমরা কাফির মুশরিকদের অনুসরণ করোনা”। আর প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব স্বকীয়তা ধারণ করার চেষ্টা করা উচিত। সেই হিসেবে মুসলিম জাতির পক্ষ থেকে এই শামসী সন রচনা করেছেন, ঢাকা রাজারবাগ দরবার শরীফের সম্মানিত শায়েখ উনার সুযোগ্য সন্তান আওলাদে রসূল হযরত খলিফাতুল উমাম আল মানসুর আলাইহিস সালাম। আলোচকগণ সরকারীভাবে বাংলাদেশের পাশাপাশি সারা মুসলিম বিশ্বে এই শামসী ক্যালেন্ডারের প্রচলন ও প্রচারের আহবান জানান।