ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমছে, আসলে কত কমানো উচিত?

ওয়ালীউর রহমান: ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমছে, আসলে কত কমানো উচিত? ভোজ্যতেলে মুনাফা হচ্ছে ৫০ শতাংশ অপরদিকে বোতলের নামে পুকুরচুরি! জনগণকে দীর্ঘদিন ধরে শুঁষে খাওয়ার পরও কি সরকার মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে না?

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমায় বাংলাদেশে লিটারে পাঁচ টাকা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে মিল মালিকরা। কিছুদিন আগে তেলের নতুন দর কার্যকর হয়েছে। সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিল মালিকরা এ দাম নির্ধারণ করেন। অবশ্য মিল মালিকরা তেলের দাম লিটারে চার টাকা কমাতে চেয়েছিলো। বাণিজ্যমন্ত্রীর অনুরোধে তারা আরো এক টাকা কমাতে সম্মত হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে ভোজ্যতেলের নামে গলাকাটা ব্যবসা করছে এ খাতের ব্যবসায়ীরা। উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি দামে খোলাবাজারে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। এ মুনাফার অংশ ভাগযোগ করে নিচ্ছে আমদানিকারক, উৎপাদক, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা তথা সরকারের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা অসৎ লোক। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমলেও দেশীয় বাজারের খুচরা পর্যায়ে দাম কমেছে খুবই সামান্য। ফলে ক্রেতারা আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমার সুফল পাচ্ছে না। এর সুফল ভোগ করছে সিন্ডিকেট।

সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম পাঁচ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের মূল্যের সবম্বয় নেই। ফলে ঠকছে ক্রেতারা। আন্তর্জাতিক বাজারে গত পরশু প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম ছিলো ৬০২ ডলার। সর্বনিম্ন তা ৫৯৯ ডলারেও বিক্রি হয়েছে। দেশে আমদানির পর এগুলো পরিশোধন করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দেয়া, প্রচার ও ব্যবসায়ীদের মুনাফাসহ প্রতি লিটারে খরচ পড়ে ৬০ থেকে ৬২ টাকা। কিন্তু খুচরাবাজারে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৮ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন এখনো বিক্রি হচ্ছে ৯৮ থেকে ১০২ টাকা লিটার।

সয়াবিন তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশি উঠেছিলো ২০০৮ সালে। এই সময়ে প্রতি টনের দাম ছিল ১ হাজার ৪১৪ ডলার। এই সময়ে দেশে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১১০ টাকা। ওই সময়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে কমেছে মাত্র ৯ শতাংশ। নতুন কমানোর দাম কার্যকর হলে প্রায় ১৪ শতাংশ কমবে। এরপরও ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের মুনাফা থাকছে। তাদের মুনাফার হার থাকছে গড়ে ৪৩ শতাংশ। অথচ দেশের ব্যবসা খাতের নৈতিকতা অনুযায়ী, কোনো ব্যবসায় ১৫ শতাংশের বেশি মুনাফা করা যুক্তিযুক্ত নয়। সেই স্থলে সয়াবিনে মুনাফা করছে ৪৭ শতাংশ, যা অস্বাভাবিক।

চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলে দাম কমতে থাকে ব্যাপকভাবে। গত জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ, আগস্টে সামান্য বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে কমে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ. অক্টোবরে কমে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ, নভেম্বরে কমেছে ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত ছয় মাসে সয়াবিনের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে শুধু আগস্টে সামান্য বেড়েছে। বাকি ৫ মাসেই কমেছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে এর দাম কমেনি।
অপরদিকে বোতলের দামের নামে উৎপাদন খরচের তিনগুণ টাকা নিয়ে ক্রেতাদের ঠকানোর অভিযোগ উঠেছে ভোজ্যতেল বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের মনিটরিং সেল হিসাব করে দেখেছে, পাঁচ লিটার পরিমাণ তেল ধরে এমন একটি বোতলের মোট উৎপাদন খরচ ২৪ টাকা ৮৬ পয়সা। কিন্তু কোম্পানিগুলো ওই বোতলের দাম নিচ্ছে ৭০ টাকা। এর আগে ওই বোতলবাবদ খরচ সরকার ৫০ টাকা বেঁধে দিলেও তা তারা মানছে না। এভাবে এক লিটার ও দুই লিটারের বোতলের দামও দুই থেকে আড়াইগুণ বেশি নেয়া হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কোম্পানিগুলো মিলগেটে যে দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করবে তার চেয়ে বোতলের দাম বাবদ ১৫ টাকা বেশি নেয়া যাবে এক লিটার বোতলের ক্ষেত্রে। দুই লিটারের ক্ষেত্রে কত টাকা বেশি নেয়া যাবে তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে পাঁচ লিটারের বোতলের ক্ষেত্রে বোতল বাবদ খরচ ৫০ টাকা নির্দিষ্ট করা আছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিনারেল পানি ব্যবসায়ীরা যেখানে ভালো মানের বোতল পানিসহ সব কর, বিজ্ঞাপন খরচ ইত্যাদি দিয়ে ১৫ টাকায় বিক্রি করে। সেখানে একটি বোতলের উৎপাদন খরচ ১৫ টাকা হলে পানি, কর ও অনান্য খরচ কোথায়? এই বিষয়টা যেন নাসির উদ্দিন হোজ্জার কাহিনীর মতো। হোজ্জার স্ত্রী নিজে এক কেজি গোশত খেয়ে ফেলে হোজ্জাকে বলে গোশত বিড়ালে খেয়েছে। হোজ্জা বিড়ালটি মেপে দেখে সেটির ওজন এক কেজি। এরপর হোজ্জার প্রশ্ন, বিড়ালটি গোশত খেলে গোশতের ওজন কোথায় অথবা বিড়ালটির ওজন কোথায়?
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পানি বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো প্রমাণ করে, বোতলের উৎপাদন খরচ অনেক কম। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা ১৫ টাকা নেয় অনেকটা প্রতারণা করে। এক্ষেত্রে মূল ব্যর্থতা সরকারের।

প্রথম যখন বোতলের দাম ১৫ টাকা ঠিক করা হয়, আমদানি, পরিশোধন ও অন্যান্য খরচ যুক্ত করে তখন এক লিটার তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০১ টাকা। তখন প্রশ্ন উঠে, বোতলের তেলের দাম কত হবে। সিদ্ধান্ত হয়, এক লিটারের বোতলের দাম কোম্পানিগুলো ১৫ টাকার বেশি নিতে পারবে। ওই সভার পর দেখা গেল কোম্পানিগুলো পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৭৫ টাকা বেশি নিচ্ছে। জানা গেছে, পরে সেটি ৫০ টাকায় বেঁধে দেয়া হয়, কিন্তু কোম্পানিগুলো তাও মানছে না।
অভিযোগ রয়েছে, বোতলের খরচের নামে বেশি দাম নেয়ার সুযোগ থাকায় কোম্পানিগুলো পলিব্যাগে যাচ্ছে না। বিশ্বের অনেক দেশেই এক লিটারের তেল বা অন্য কোনো তরল পণ্য পলিব্যাগে বাজারজাত করার নজির আছে। বাংলাদেশে সব তরল দুধ পলিব্যাগেই সরবরাহ করা হয়। এটা করা গেলে লিটারে অন্তত ১০ টাকা কম দামে তেল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, ভোজ্যতেল ব্যবসায় বাড়তি দামের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার বাড়তি আয় করেছে আমদানিকারক ও তাদের সাথে আঁতাতকারী সরকারি কর্তা ব্যক্তি তথা সিন্ডিকেট। ক্রেতা স্বার্থ রক্ষা সরকারের কর্তব্য বলে বিবেচিত হলেও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে তাদের অসহায়ত্ব যেভাবে প্রমাণিত হচ্ছে তা দুর্ভাগ্যজনক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট