বিশ্বে তৈরি পোশাক কারখানার ব্র্যান্ড এখন বাংলাদেশ

ঢাকা: ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ও ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর দেশের তৈরি পোশাক খাতের কারখানা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল, তা পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পে উন্নতমানের সবুজ কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি) নির্মাণে সারাবিশ্বে এখন শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) হিসেবে, বিশ্বের প্রথম ১০টি উন্নতমানের কারখানার ৭টিরই অবস্থান বাংলাদেশে।

সম্প্রতি সংগঠনটি বাংলাদেশের ১৩টি পোশাক কারখানাকে প্লাটিনাম ক্যাটাগরিতে ‘লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন-লিড’ সনদ দিয়েছে। আর গোল্ড সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ২০টি এবং সিলভার সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ২৭টি। সাধারণভাবে পরিবেশবান্ধব হিসেবে সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ৭টি।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারখানাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করবে। নেতিবাচক ধারণা দূর করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরও রাখবে শক্তিশালী ভূমিকা। এখন দেশের রফতানি আয়ের ৭৬ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসেবে, এ পর্যন্ত ৬৭টি গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল কারখানা ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিবিসির স্বীকৃতি পেয়েছে। আরও ২২৭টি কারখানা পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে গড়ে উঠছে। এগুলো আগামী দুই বছরের মধ্যে এ সনদ পাবে।

অন্যদিকে, প্রতিবেশী ভারতের মাত্র পাঁচটি পোশাক কারখানা লিড সনদ পেয়েছে। সেদেশে এ তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য অপেক্ষায় আছে আরও ২০টি কারখানা। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম এ তালিকায় অনেক নিচে অবস্থান করছে।

তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের দাবি, ইউএসজিবিসির তালিকা অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব কারখানার মান বিচারে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তিনটি কারখানাও বাংলাদেশে। এর মধ্যে দুটি নারায়ণগঞ্জে, অন্যটি পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে (রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা) অবস্থিত।

পরিবেশবান্ধব স্থাপনার শর্ত পরিপালন বিবেচনায় প্লাটিনাম, গোল্ড ও সিলভার সনদ দেয় ইউএসজিবিসি। এর বাইরে পরিবেশবান্ধব হিসেবেও সনদ দেয়া হয়। সব শর্ত পরিপালন করা হলে কারখানাটি প্লাটিনাম হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে এরকম কারখানার সংখ্যা ১৩টি। এর পেছনে থাকা কারখানা গোল্ড এবং তারও পেছনে থাকা কারখানা সিলভার হিসেবে সনদ পায়। দেশে গোল্ড ও প্লাটিনাম সনদ পাওয়া কারখানা যথাক্রমে ২০ ও ২৭টি। আর সাধারণভাবে পরিবেশবান্ধব হিসেবে সনদ পাওয়া কারখানা এখন ৭টি।

ইউএসজিবিসির শর্ত অনুযায়ী, পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় তা হলো, ১. কারখানা নির্মাণে কী ধরনের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে; ২. কারখানায় সূর্যের আলোর কী পরিমাণ ব্যবহার হয়; ৩. সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার করা হয় কিনা; ৪. কারখানার নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে শ্রমিকদের বাসস্থান আছে কিনা; ৫. স্কুল, বাজার করার ব্যবস্থা বা বাসস্ট্যান্ড রয়েছে কিনা; ৬. সূর্যের আলো ব্যবহার করার পাশাপাশি সৌরবিদ্যুত ব্যবহার এবং বিদ্যুতসাশ্রয়ী বাতি ব্যবহার করা হয় কিনা; ৭. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ব্যবহার করা হয় কিনা; ৮. কারখানা নির্মাণে নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা রাখা হয়েছে কিনা; ৯. অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কিনা; ১০. বৈদ্যুতিক ফিটিংস স্থাপন ছাড়াও অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা।

পৃথিবীর সব দেশ পরিবেশবান্ধব স্থাপনার ক্ষেত্রে ইউএসজিবিসির সনদ পায় না। অনেক দেশই নিজস্ব পরিবেশবান্ধব নীতিমালার আলোকে স্থাপনা তৈরি করে। তবে এজন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের বিনিয়োগে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ জন্য সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের বিষয়টি বহুল আলোচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রিন ফিন্যান্সিংয়ের আওতায় সহজ শর্তে (সিঙ্গেল ডিজিট সুদে) ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে।
ইউএসজিবিসির লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (এলইইড বা লিড) সনদ পাওয়া শীর্ষ তালিকায় থাকা কারখানাগুলো হচ্ছে রেমি হোল্ডিংস, প্লামি ফ্যাশন্স, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, এসকিউ সেলসিয়াস-২, এসকিউ বিরিকিনা-১, এসকিউ বিরিকিনা-২, জেনেসিস ওয়াশিং ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তা হলো অনেক টাকা বিনিয়োগ করা এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের কাঙ্খিত দর পাওয়া। এ ধরনের কারখানা বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে সম্ভাবনা তৈরি করবে নিঃসন্দেহে। এখনই ভালো ক্রয়াদেশ নাও হতে পারে। তবে কারখানা সংস্কারের চলমান গতি অব্যাহত রাখতে হবে এবং অবকাঠামোগত অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তখন ধীরে ধীরে এর সুবিধা পাওয়া যাবে। আর এগুলো করতে হলে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ চলমান রাখতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘তাজরীন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সারাবিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়। গার্মেন্টসের দরাদরিতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের শক্তি কিছুটা খর্ব হয়। বর্তমানে তৈরি পোশাকের এসব কারখানা গ্রিন কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলেছে। এসব কারখানাই আগামীতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন সারাবিশ্বে পরিচিত। তাজরীন ও রানা প্লাজা ধসের পরের নেতিবাচক অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। গার্মেন্টস পণ্য আগামীতে দেশের রফতানী বাণিজ্যে আরও বেশি অবদান রাখবে।