লিবিয়ায় গিয়ে মাফিয়াদের হাত থেকে ছেলেকে ফিরিয়ে আনলেন মা

কুমিল্লা সংবাদদাতা: অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে বসতভিটার একটি অংশ বিক্রি করে একমাত্র ছেলে ইয়াকুবকে লিবিয়ায় পাঠান মা শাহিনূর বেগম। কিন্তু অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়ারা অপহরণ করে ইয়াকুবকে।

ছয় মাস ধরে ছেলের খোঁজ না পেয়ে পাগলপ্রায় মা সুদূর লিবিয়া গিয়ে মাফিয়াদের হাতে বন্দী ছেলেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন।

জানা যায়, তার স্বামী লিবিয়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বসতভিটার একটি অংশ বিক্রি করে ২০১৯ সালে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান। সেখানে গিয়ে তেলের কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। তার স্বামী ও ছেলে লিবিয়ায় কাজ করে যে টাকা পাঠাতো তা দিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। ২০২১ সালের শুরুতে ছেলে মোবাইলে বলে- ‘মা আমি অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যেতে চাই। সেখানে ভালো টাকা ইনকাম। তখন জাহাঙ্গীর নামে এক দালালকে চার লাখ টাকা দিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার পথে নৌকা লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে।

সেখানে নির্যাতন সহ্য করে ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্টগার্ডকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে ইয়াকুবকে ছাড়িয়ে আনে তার বাবা আবুল খায়ের। এ ঘটনার আট মাস পর ইয়াকুব আবারও স্বপ্ন দেখে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার। তখনই ঘটে অঘটন। ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়াদের হাতে ধরা পড়ে ইয়াকুব। ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

ছেলে ইয়াকুব বলেন, মাফিয়ারা আমাকে আটক করে মোবাইল ও টাকা-পয়সা সব রেখে দেয়। এ সময় সেখানে আমাকেসহ প্রায় ৩০০ জনকে মাটির নিচে একটি ছোট অন্ধকার রুমে রাখা হয়। চোখের সামনে কত মানুষ একটু খাবারের জন্য হাহাকার করেছে। কত মানুষকে অসুস্থ হয়ে মরতে দেখেছি। বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনেছি। ঠিকমতো খাবার দিত না।

তিনি বলেন, মাফিয়াদের কাছে অনেক আগে আটক হওয়া সাতজন বাঙালি নিয়ন্ত্রণ করত। তারা অনেক মারধর করত। কারণ মাফিয়ারা বলেছিল ঠিকমতো শাসন করতে পারলে তাদের ছেড়ে দেবে। তাই তারা কথায় কথায় মারত। মারধরের ক্ষত চিহ্ন ও পোকামাকড়ের কামড়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে পচন ধরে। ৩০০ জনের জন্য ৩০০ রুটি দিলে সেই ৭ জন বাঙালি প্রায় ৩০-৪০টি রুটি রেখে দিত। বাকি রুটি আমরা ভাগ করে খেতাম। মাফিয়ারা বাঙালি দালালের মাধ্যমে জিম্মি করার বিষয়টি সবার পরিবারকে জানায়। ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে আমার পরিবার থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েও আমাকে ছাড়ত না।

প্রায় ছয় মাস ছেলের সন্ধান না পেয়ে তার মা সিদ্ধান্ত নেয় ছেলের খোঁজে নিজেই লিবিয়া যাবে। তারপর অসুস্থ লিবিয়াপ্রবাসী স্বামীর সহযোগিতায় ভিসা ও বিমানের টিকিট সংগ্রহ করেন।

২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি লিবিয়ায় রওনা হয়ে তার মায়ে মাথায় শুধু একটা চিন্তা- এত টাকা খরচ করে লিবিয়া যাচ্ছি, সেখানে গিয়ে ছেলেকে কীভাবে খুঁজব। কিছু বাঙালির সহযোগিতায় লিবিয়ার বেনঘাজিতে স্বামীর কাছে যাই। তখন আমার স্বামী খুব অসুস্থ ছিলেন। তাই নিজেই ছেলের খোঁজে বের হয়ে পড়ি।

ছেলে ইয়াকুব বলেন, কয়েকমাস চেষ্টা করার পর আমাদের দেখাশোনা করত-এমন একজনের থেকে একটি মোবাইল চেয়ে নিতে সক্ষম হই। তখন বাবাকে কল দিয়ে বলি, মাফিয়ারা আমাকে আটকে রেখেছে। আমার জায়গার নাম বলি এবং কোনো দালালকে টাকা না দিয়ে অন্য কোনো পদ্ধতিতে আমাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অনুরোধ করি। মাত্র ১৭ সেকেন্ড কথা বলতে পেরেছি।

ছেলের কল পাওয়ার পর তখন তার মা লিবিয়ায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন বাঙালিকে ছেলের বিষয়টি খুলে বলে। তাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

আইওএমের কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সহযোগিতায় ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। সেই সঙ্গে সেখানে বন্দি থাকা আরও ২৫০ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়।
মায়ের সাহসী ভূমিকা নিয়ে ইয়াকুব বলেন, আমার মা পৃথিবীর সেরা মা। আমি মরে যাব সেটা ভেবেছি, কিন্তু আমার মা আমাকে উদ্ধার করার জন্য টাকা ধার করে লিবিয়া যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আবারও প্রমাণ হলো মায়ের ভালোবাসার কোনো তুলনা করা যায় না।

প্রতিবেশী ওমর ফারুক বলেন, লিবিয়া গিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করে মা ঘরে ফিরেছেন- বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে এই ছেলের জন্য। মায়ের এমন ভালোবাসা বাংলাদেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।