যেভাবে ধরা পড়লো বাউল ছদ্মবেশী সিরিয়াল কিলার

নিজস্ব প্রতিবেদক: তিনটি হত্যাকা-, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বগুড়ার হেলাল হোসেন। ‘খুনি হেলাল’, দুর্ধর্ষ হেলাল’ নামে এলাকায় পরিচিত হয়ে ওঠে সে। এরপর বাউলের বেশ ধারণ করে। তবে বাউলের বেশ ধারণের পর সে ‘সেলিম ফকির’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। পথে পথে ঘোরার পর থিতু হয় রেলওয়ে স্টেশনে।
বছরখানেক তার একটি গানের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পরিচিতজনরা তাকে চিনে ফেলে। তার পরিচয় নিশ্চিত হয় স্থানীয়রা। এরপর হেলালের বেশভূষা বদলের তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ করে র‌্যাবে।

স্থানীয়দের তথ্য ধরে ছয় মাস চেষ্টার পর র‌্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন। গত বুধবার (১২ জানুয়ারি) রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে হেলাল হোসেন ওরফে খুনি হেলাল ওরফে সেলিম ফকিরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

র‌্যাব জানিয়েছে, হেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় তার সাজাও দিয়েছে আদালত। এছাড়া আরও দুটি ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন হেলাল হোসেন। তার বাড়ি বগুড়ায়। এক সময় মুদিখানার দোকান চালাতো সে। পরে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন মাজার ও রেলওয়ে স্টেশনে থাকা শুরু করেন। কেউ যাতে তার চেহারা চিনতে না পারে, সেজন্য লম্বা দাঁড়ি ও চুল রাখে। একটি বাউল গানের শুটিংয়ের সময় তাকে মডেল হিসেবে অভিনয় করানো হয়। সেই গানের ভিডিও দেখে স্থানীয়রা শনাক্ত করেন বাউল ছদ্মবেশী সেলিম ফকির আসলে একজন খুনি। সেই খুনি হেলাল।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ছয় মাস আগে এক ব্যক্তি ইউটিউবে প্রচারিত একটি গানের বাউল মডেল সম্পর্কে র‌্যাবের কাছে তথ্য দেয়। তখন জানানো হয়, এই বাউল মডেল সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলার আসামি। অভিযোগ পেয়ে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয় র‌্যাব।

ছদ্মবেশী হেলাল ফকিরের যত অপরাধ:
২০০১ সালে বগুড়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকা-ে নিহতের পরিবারের একজন সদস্য বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। ২০০৬ সালে রবিউল নামে এক ব্যক্তিকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। সেই মামলায়ও হেলাল চার্জশিটভুক্ত আসামি।

এছাড়া ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়। এছাড়া ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেফতার হন হেলাল ওরফে বাউল হেলাল। তাছাড়া নারী নির্যাতন আইনেও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের কারণে নিজ এলাকায় ‘দুর্ধর্ষ হেলাল’, খুনি হেলাল’ নামে পরিচিতি পায় সে।

যেভাবে ফেরারি জীবনে হেলাল:
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে পরে মুদিখানার দোকান চালাতো হেলাল। ২০১০ সালে চুরির মামলায় গ্রেফতার হয়। এরপর ২০১৫ সালে জামিন পায়। ওইদিনই বিদ্যুৎ হত্যা মামলার রায় হয়। রায়ে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় দেয়। আদালতে হাজির না হয়ে সে কৌশলে এলাকা ছাড়ে। এরপর শুরু হেলালের ফেরারি জীবন।

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে হেলাল জানিয়েছেন, প্রথমে সে বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যায়। সেখানে আমানত শাহের মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে। পরে ট্রেনে সিলেটের হজরত শাহজালাল মাজারে চলে যায়। সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করে। এভাবে সে বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনে গিয়ে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন করে হেলাল। নিজেকে সেলিম ফকির নামে পরিচয় দেন। সেখান থেকে সে সেলিম ফকির নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের দিকে হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব পায়।