বৈশাখের পান্তা-ইলিশ ভ্রান্ত রীতি : বিশেষজ্ঞদের অভিমত

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ঢাকা: ফসলী নববর্ষ উপলক্ষে হুজুগে মাতা একটি শ্রেণী পান্তা ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ অনুসরণ করে। বিশেষজ্ঞরা জানায়, ইলিশ খাওয়ার এই রীতি আমাদের বাংলাদেশী ঐতিহ্য তো নয়-ই, উপরন্তু এই অর্বাচীন প্রথা আমাদের ইলিশ সম্পদের ধ্বংসের কারণ। ফসলী বর্ষবরণ যে কয়টি জিনিস এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে একটি জঘন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে পান্তা-ইলিশ খাওয়া।

কোথা থেকে এল পান্তা-ইলিশ?
কালের পরিক্রমণে অনেক সংস্কৃতির গ্রহণ বর্জনে আমাদের মূল সংস্কৃতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে অবশ্যই! তবে পান্তা-ইলিশ আমাদের দেশের মানুষের আদি খাদ্যাভ্যাসে ছিল- এমন রীতি কোথাও পাওয়া যায় না।
ইতিহাসের জন্ম থেকে যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন ফসল ধান, সে দেশে প্রধান খাদ্য তাই হবে- এটাই স্বাভাবিক! আদিকাল হতেই সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সর্বস্তরের লোকের প্রাধান খাদ্য ছিল ভাত, হয়তো রান্নার পদ্ধতিতে কিছুটা তারতম্য হতো!

চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগের একটা বই, প্রাকৃত ভাষার গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’-এ উল্লেখ আছে- ‘ওগগারা ভত্তা গাইক ঘিত্তা’। মানে হলো, খাঁটি ঘি সহযোগে গরম ভাত!

এসব কিছু থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, এদেশের মানুষের প্রাচীন রীতি ছিল গরম ফেনায়িত ভাত ঘি সহযোগে খাওয়া!
প্রাচীন কোনো গ্রন্থেই পান্তা-ইলিশ খাওয়ার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। নদীবহুল বাংলায় স্বাভাবিকভাবেই মাছ খাদ্য তালিকায় অন্যতম জায়গা করে নিয়েছিল। তবে বাঙালির এই মৎস্যপ্রীতি আর্য সভ্যতার সংস্কৃতি কোনোদিন সুনজরে দেখেনি!
ইলিশ খাওয়ার এই ভুঁইফোড় রীতি তৈরি হয়েছে খুব সম্প্রতি। বিধর্মীদের কতিপয় পূজা উৎসব অনুসরণে ‘বর্ষবরণ’ উৎসব এবং সংস্কৃতিতে অনুপ্রাণিত গোষ্ঠী চারুকলার আয়োজনে বিধর্মীয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জমে যাওয়ার পরে যখন ছায়ানটের বটতলা এলাকাকে ঘিরে লোক সমাগম হতে থাকে, তখন কিছু অস্থায়ী মেলার সঙ্গে খাওয়ার দোকানও বসে। মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়া মূলত এইসব মুনাফখোর দোকানীদের আবিষ্কার। যা পরে খুব দ্রুত অন্যরাও গ্রহণ করে। প্রাচীন বাংলা বা বাংলা (ফসলী) সনের সঙ্গে এই ইলিশ খাওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. কাজী আহসান হাবীব জানান, পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ খাওয়ার এই প্রথা আমাদের দেশের ইলিশ সম্পদের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয়, এই প্রথা ধ্বংস করে দিতে পারে আমাদের গর্বের এই সম্পদ। ড. হাবীব বলেন, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ রক্ষার করার জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনে বলা আছে- ২৩ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চির নিচের কোনো মাছ ধরা নিষেধ। এই আকারের ইলিশকে জাটকা মাছ বলে। ইলিশের জীবনচক্রে এই জাটকা সময়টা পার করে নভেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যে। তাই এই সময়টা মাছ ধরা আইন করে নিষেধ করা হয়েছে।

ধরা নিষেধ হলেও ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জাটকা মাছ ধরা হয় মার্চ থেকে মে মাসেই। এই সময় মাছগুলো ১০ ইঞ্চির কাছাকাছি হয়। বলাবাহুল্য, এটা পহেলা বৈশাখের প্রভাবেই হয়। বাজারে এ সময়ে ইলিশ মাছের বিপুল চাহিদা থাকে এবং বেশি চাহিদা মানেই বেশি মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা। অসময়ে সারাদেশ যদি এভাবে ইলিশ মাছ খাওয়ার উৎসবে মেতে উঠে, তবে মৌসুমে ইলিশ তো পাওয়া যাবেই না- উল্টো ইলিশের সার্বিক মজুদেও প্রভাব পড়বে। “বছরের পর বছর এটা চলতে থাকলে একটা সময় ইলিশ নামের মাছটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় অসম্ভব নয়”, জানান ড. হাবীব।

তিনি আরও যোগ করেন, ২০১৩-১৪ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট মৎস্য সম্পদের ১১ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। যার মূল্যমান প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের মোট জিডিপি’র ১ শতাংশ অবদান ইলিশের। প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের জীবিকা ইলিশ মাছকে ঘিরে। ইলিশ মাছের ধ্বংস তাই শুধু মাছটির বিলুপ্তি না, জীবিকারও বিলুপ্তি। এসব কারণেই আইনটা মানার বিষয়ে সরকার বেশ কড়া অবস্থানে রয়েছে। তবে এসব আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে শহরের বাজার, সুপার মলে দেদাছে ছোট ইলিশ মাছ বিক্রির উৎস চলছে।

এর প্রভাব শুধু এতটুকুই নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের মূল্যস্ফীতির মান গত ৪০ মাসে প্রথম ৬ শতাংশের নিচে নেমেছে। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে তা ছিল ৫.৬২ ও ৫.৬৫ শতাংশ। শুধুমাত্র সবাই মিলে ইলিশ কেনার ধুমে এইমাসের মূল্যস্ফীতি আবার ৬ শতাংশের উপরে চলে যাবে।

সম্প্রতি জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটির একটি সভায় স্বয়ং পরিকল্পনা মন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, এ মাসে এভাবে ইলিশ কেনার কারণে দেশের মূল্যস্ফীতি দশমিক ০১ শতাংশ হলেও বৃদ্ধি পাবে। এটি একটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির হিসাবে বেশ বিপজ্জনক পরিস্থিতি।