স্বপ্নপূরণে বিদেশগামী যুবকদের স্বাবলম্বীর পথ দেখালেন শেখ পলাশ

কলাগাছের বাগানে ঘেরা একটি মাছচাষের পুকুরকুষ্টিয়া : বিদেশ-বিভূঁই ঘুরে স্বপ্নপূরণে দেশকেই বেছে নিয়েছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ২৬ বছরের যুবক শেখ পলাশ। এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি এলাকার বেকারদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হোক- এটাই তার চাওয়া।

শেখ পলাশের পড়ালেখা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্তই। এরপর লেখাপড়ার ইতি টেনে অর্থ উপার্জনের স্বপ্নে বিভোর হন। চলে যান দক্ষিন আফ্রিকাতে। কিন্তু দেশের জন্য মন কাঁদে তার। তার মনকে ধরে রাখতে পারেনি কাক্সিক্ষত প্রবাস । পাঁচ বছর পরে চলে আসেন নিজের গ্রামে। স্বপ্ন দেখেন এলাকার যুবকদের জন্য কিছু একটা করার। এরই সূত্র ধরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধিনে গবাদী পশু, হাঁস-মুরগী পালন, মৎস্য চাষ ও কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের অর্থায়নে ২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে পুকুর করে মাছ চাষ শুরু করেন।

বর্তমানে তিনি মাঠের এক কোনে ১২ বিঘা জমির উপরে ৬টি পুকুর খনন করে সেখানে মাছ চাষ করছেন। পুুকুরে মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছ ও শাক-সবজির চাষও করেছেন।

শেখ পলাশ বলেন, ‘আমি মনে করেছিলাম বিদেশে গিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। কিন্তু প্রবাসে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে প্রবাসে থাকার চেয়ে গ্রামে থেকে গ্রামের মানুষের একটু উপকার করা ও যুবকদের জন্য কিছু করা অনেক ভালো। এই গ্রামের শিক্ষিত বেকারদের জন্য কিছু করা- এটা আমার স্বপ্ন। আর আমি আমার এই স্বপ্নটা পূরণ করতে চাই। এজন্যই সরকারী কোন সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই আমি এই মৎস্য খামার তৈরি করেছি।’

তিনি বলেন, ‘এখানে আমি বর্তমানে ১২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ৬টা পুকুর করেছি। এই পুকুরে বর্তমানে প্রায় ৪ মন ধানি পোনাসহ ৩০ মন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রয়েছে। এর মধ্যে মিনার কার্প, গ্রাস কার্প, রুই, মৃগেল ও কাতল রয়েছে। পুকুরে বর্তমানে তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজনের রুই ও কাতল মাছ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া আমি পুকুরের পাড়ে সব্জি বাগান ও ফলের বাগান করেছি। এতে আমার পুকুরের পাড় মজবুত হয়েছে এবং আমি ভালমানের শাক-সব্জি পাচ্ছি। এ ছাড়া এতে আমার পুকুরে বাড়তি ঘেরার প্রয়োজন হচ্ছে না এবং পরিবেশও ভালো হচ্ছে। বর্তমানে এই পুকুর পাড়ে ২৫০টি পেঁপে গাছ, ৬০০ টি কলাগাছ, ৬০টি লেবু গাছ, ১২০টি মেহগনি গাছ রয়েছে। গাছের পাশাপাশি পুকুর পাড়ে কদু, টমেটো, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, ঝালসহ বিভিন্ন সব্জি রয়েছে। এতে আমার মাছের চাষের পাশাপাশি বাড়তি আয়ও হচ্ছে।’

গত বছর এই পুকুর পাড় থেকে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার কলা ও ৯৫ হাজার টাকার সব্জি বিক্রি করেছেন, এ বছর আরো বেশি বিক্রি করতে পারবেন বলেও জানান তিনি।

খামারের পরিধি দেখাচ্ছেন শেখ পলাশ

এই মৎস্য খামারে বর্তমানে ৬ জন যুবক কাজ করে। এ ছাড়া বাড়তি কাজের লোকতো প্রতিদিনই থাকে। এখান থেকে তাদের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে।

তিনি পাশ্ববর্তী ১৫ বিঘা জমি বর্গাও নিয়েছেন। এখানে একটি গরুর ফার্ম ও একটি আধুনিক লেবুর বাগান করতে চান তিনি। তিনি বলেন, ‘এবার পুকুরে মাছের পাশাপাশি পুকুর পাড়ে হাঁস চাষ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। আমি মনে করি এতে আমার এলাকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হবে। এ ছাড়া আমি মনে করছি এবার এলাকার বেকার যুবকদের উন্নয়নের জন্য একটি সমিতি গঠন করবো। যার সম্পূর্ণ মালিকানা থাকবে সমিতির সদস্যরাই। সেখান থেকে তাদের উন্নয়নের জন্য ঋণ দেওয়া হবে এবং তার লভ্যাংশ তাদের উন্নয়নেই থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমার কয়েকজন বন্ধু মানিক, রাজিব শেখ, জাহিদুল ইসলাম, লতিফুল, শেখ হারুন, লিংকন, হাফিজ আমার এ খামারের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এরা প্রথম থেকেই আমার এ কাজে উৎসাহ প্রদান করে এসেছে। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে আমি আমার এ স্বপ্নকে খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবায়ন করতে পারবো।’

শুধু খামারই নয় তিনি নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য মিরপুর বাজারে ‘নেহা ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাকের দোকান, কৃষকের জন্য ‘শেখ এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি সারের দোকান স্থাপন করেছেন।

এ ব্যাপারে মিরপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম নান্নু বলেন, ‘যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষন নিয়ে অনেকে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছেন। আমরা সর্বদা বেকার যুবকদের জন্যই কাজ করি। তারা যাতে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে সে জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আর শেখ পলাশ এই এলাকার একটি দৃষ্টান্ত। সে যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ স্বাবলম্বী হয়েছে। তাকে দেখে এলাকার যুবকরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রেরণা পাচ্ছে।’