দ্বিগুণ লাভে গাজর চাষে বিপ্লব!

দ্বিগুণ লাভে গাজর চাষে বিপ্লব!

নিউজ ডেস্ক: গাজর চাষে যেন বিপ্লব ঘটেছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায়। প্রতিটি গ্রামেই কম বেশি চাষ হয় মূল জাতীয় এই সবজির। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন কৃষকের মাঝে আগ্রহও বাড়ছে গাজর চাষে।

শীত মৌসুমে এ এলাকার প্রধান অর্থকারী ফসল এই গাজর। সারাদেশেই এই গাজরের চাহিদা রয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সীমিত আকারে রফতানিও হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

কৃষি অফিস ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিংগাইর উপজেলায় গাজর চাষ শুরু হয় দুই দশক আগে। প্রথম দিকে শুধু মাত্র জয়মন্ডপ ইউনিয়নে স্বল্প পরিসরে এর চাষাবাদ শুরু হয়।

কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় ধীরে ধীরে গাজর চাষে আগ্রহ বাড়ে কৃষকদের। ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার প্রায় সকল গ্রামে। গাজর চাষ করে অনেক পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা। হয়েছে কর্মসংস্থানও।

উপজেলার জয়মন্টপ, কিটিংচর, লক্ষ্মীপুর, নীলটেক, মেদুলিয়া, ভাকুম, কানাইনগর, মোসলেমাবাদ, বিন্নাডাঙ্গী, চর দূর্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি কৃষক গাজর চাষের সঙ্গে জড়িত।

গাজরচাষি কানাই লাল, আকবর ও রশিদের সাথে কথা হলে তারা জানান, অন্য ফসলের চেয়ে গাজর চাষ লাভজনক বেশি। মাত্র দুই থেকে আড়াই মাসে ফসল তোলা যায়। গাজর তুলে ধান চাষ করেন তারা। প্রতি হেক্টর জমিতে গাজর উৎপাদন হয় ১৮ থেকে ২০ টন।

খেতে থাকা অবস্থাতেই ব্যবসায়ীরা চাষিদের গাজর কিনে নেন। তাই গাজর তুলতে কোনো ঝক্কি ঝামেলা নেই কৃষকদের।

একইসঙ্গে ব্যবসায়ীদেরও গাজর তুলতে কোনো শ্রমিক লাগে না। কারণ গো-খাদ্যের জন্য গাজরের পাতার (উপরের অংশ) বেশ চাহিদা রয়েছে স্থানীয়দের কাছে। তাই গরুর খামারীরাই খেত থেকে গাজর তুলে দিয়ে পাতা নিয়ে যান।

স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবুবকর সিদ্দিক জানান, এ অঞ্চলে কিংঅরেন্স নামে হাইব্রিড গাজর বেশি ফলন হয়। এ বীজ জাপান থেকে আমদানি করা। প্রতি কেজি বীজ কৃষকদের কিনতে হয় ১২ হাজার টাকা করে। এক কেজি বীজ এক বিঘা জমিতে বপন করা যায়। প্রতি বিঘায় গাজর চাষে খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। লাভ থাকে প্রায় দ্বিগুণ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সিংগাইর উপজেলার গ্রামে গ্রামে এখন খেত থেকে গাজর তোলা, ধোয়া এবং বাজারজাত করার মহাকর্মযজ্ঞ চলছে। গ্রামের নারী-পুরুষ জমি থেকে দল বেঁধে গাজর তুলছেন।পাতা কেটে নিচ্ছেন। আবার সেই গাজর বিভিন্ন খাল-বিলের পাশে কিম্বা বাড়িতে গর্ত করে ধোয়া হচ্ছে।

শ্রমিকরা সারিবদ্ধভাবে বসে বিশেষ কায়দায় গাজর পরিষ্কার করছেন। এরপর ট্রাকে করে বিভিন্ন আড়তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই গাজর।

বছরের এই সময়ে শুধু গাজর ধোয়ার জন্য রাজশাহী, নাটের, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলার শ্রমিক আসেন সিংগাইরে। ১০০ টাকা বস্তা চুক্তিতে তারা গাজর তুলে ধুয়ে বাজারজাত উপযোগী করে দেন।

ঢাকার কারওয়ান বাজারের বেপারী আমজাদ হোসেন। জয়মন্ডপ গ্রামে এসেছেন গাজর কিনতে।

তিনি বলেন, মানিকগঞ্জের সুস্বাদু গাজরের চাহিদা অনেক। রাজধানীর পাশে হওয়ায় তারা এখান থেকে প্রতি বছর গাজর কিনে নেন। একইভাবে কারওয়ান বাজার, শ্যাম বাজার, মিরপুর ও সাভারের পাইকারী আড়তে এই গাজর সরবরাহ করা হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, সীমিত আকারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও সিংগাইরের গাজর রফতানি হচ্ছে।

নিজ এলাকার চাষিদের গাজর সংরক্ষণের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে জয়মন্ডপ এলাকায় একটি হিমাগার তৈরি করেছেন সংসদ সদস্য ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। মধু-উজালা নামের ওই হিমাগারে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন আলু এবং গাজর রাখা যায়।

চাষিরা বলছেন, সংরক্ষণের ব্যবস্থা কম থাকায় তারা স্বল্প মূল্যেই গাজর বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই এলাকায় আরও হিমাগার নির্মাণ করা হলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হতেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, সিংগাইর উপজেলায় ২০১৮ সালে ১ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে গাজর চাষ হয়।২০১৯ সালে গাজর চাষ হয় ১ হাজার ১১৭ হেক্টর জমিতে এবং চলতি বছরও একই পরিমাণ জমিতে গাজর চাষাবাদ হয়েছে।

সিংগাইর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা টিপু সুলতান জানান, সিংগাইর উপজেলার মাটি এবং আবহাওয়া গাজের চাষের জন্য উপযোগী। এজন্য গাজর চাষে কৃষকরা উৎসাহিত হন। তাছাড়া গাজর চাষ অন্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভজনক। বিক্রি নিয়েও চাষিদের কোনো ঝক্কি ঝামেলা নেই। খেত থেকেই গাজর কিনে নেন ব্যবসায়ীরা।

এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকারী ফসল এখন গাজর। প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি টাকার গাজর বিক্রি হয় এই উপজেলা থেকে।

তিনি আরও বলেন- কিভাবে গাজরচাষিরা পরিকল্পিত চাষাবাদের মাধ্যমে আরও ভালো ফলন পেতে পারেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন সময় তারা পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে থাকেন।