জালিম বাদশাহ আকবরের দ্বীনে এলাহী তছনছ করে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যিনি

পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার গৌরবময় ইতিহাসে যুগে যুগে যতপ্রকার যুলুম অত্যাচার এসেছে তার প্রতিটির মূলেই ছিল ওই যুগের যালিম ফাসিক-ফুজ্জার শাসকদের কুৎসিত ভূমিকা। তারা তাদের ক্ষমতার যাচ্ছেতাই ব্যবহারের জন্য পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বিধিবিধানকে কাটছাঁট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতো। বিপরীতে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক রব্বুল ইজ্জত তিনি যালিম শাসকদের অপচেষ্টাকে রুখে দেয়ার জন্য উনার খলীফা হিসেবে মুজাদ্দিদ ওলীআল্লাহগণ উনাদেরকে বিশেষভাবে প্রেরণ করেন। বিশ্ব ইতিহাসে এমনই এক প্রতাপশালী বাদশাহ ছিল সম্রাট আকবর। সে হিন্দু মুশরিক, ইহুদী নাছারা আর বিশেষ করে দুনিয়াদার ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনাকে উচ্ছেদের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। নাউযুবিল্লাহ!
ওই সময় খালিক্ব মালিক রব তিনি কাইয়্যুমে আউওয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে মুসলিম উম্মাহ উনাদের রাহবার হিসেবে প্রেরণ করেন। তিনি একাধিকবার যালিম বাদশাহ আকবরকে সরাসরি নছীহত মুবারক করে যুলুম থেকে ফিরে আসার আহবান জানান। যালিম সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে উনাকে কষ্ট দেয়ার অপচেষ্টা করলেও তিনি আরো জোরালো ভাষায় পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার আমল-আখলাক-আক্বীদা উনাদের বেমেছাল সৌন্দর্যকে যালিম বাদশাহর সামনে তুলে ধরেন। এর মাধ্যমে তিনি মূলত সুমহান পবিত্র হাদীছ শরীফ- “যালিম শাসকের সম্মুখে হক্ব কথা বলে দেয়াটা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ” উনার বাস্তব প্রয়োগ ঘটান। সুবহানাল্লাহ! বিভিন্নভাবে যালিম শাসকগোষ্ঠী গং উনাকে কষ্ট দেয়ার অপচেষ্টা করলেও তিনি বিন্দুমাত্রও হক্ব কথা বলা এবং হক্ব বিষয় প্রচার-প্রসার করা থেকে বিরত হননি। উনার বেমেছাল প্রবল প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যালিম শাসকগোষ্ঠী পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার অবমাননা বিকৃতি ঘটানো ইত্যাদি থেকে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সুবহানাল্লাহ!
অতএব, প্রতিযুগেই ঈমানদীপ্ত মুসলিম মিল্লাত উনাদের বেমেছাল আদর্শ হলেন সাইয়্যিদুনা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি। বর্তমান কঠিন সময়ে সকল মুসলিমকে উনার সুমহান মুবারক আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে উঠা দায়িত্ব কর্তব্য হয়ে পড়েছে।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সম্পর্কে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ:
দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুবারক তাশরীফ আনয়নের ভবিষ্যদ্বাণী স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মাঝে ব্যক্ত করেছেন। তিনি পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন- “হিজরী একাদশ শতকের প্রারম্ভে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি মিল্লাতে মুসলিমায় এমন এক ব্যক্তিত্ব উনাকে প্রেরণ করবেন যিনি হবেন একটি বৃহৎ নূর বা আলোকবর্তিকা। উনার নাম মুবারক আমার নাম মুবারক উনারই অনুরূপ হবে। দুই অত্যাচারী তথা যালিম বাদশাহর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি তাশরীফ আনবেন। উনার মুবারক শাফায়াতে অসংখ্য অগণিত লোক জান্নাতের অধিবাসী হবেন।” সুবহানাল্লাহ!
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ধারাবাহিকতায় পবিত্র ইলহাম মুবারক উনার মাধ্যমে একদা সাইয়্যিদুনা হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার তাশরীফ মুবারক আনার সুসংবাদপ্রাপ্ত হন। একদা উনার প্রতি ইলহাম মুবারক হলো-
“হে গাউছে পাক রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনার মুবারক উপস্থিতির পাঁচশত বৎসর পর দুনিয়াবাসীর মধ্যে আবারো শিরক বিদয়াতের ব্যাপকতা প্রকাশ হয়ে যাবে। সে সময় উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মধ্যে থেকে একজন বেমেছাল ওলীআল্লাহ যমীনে তাশরীফ আনবেন। তিনি মিল্লাতে মুসলিমা থেকে শিরক বিদয়াত নাস্তিকতা ইত্যাদিকে ধ্বংস করবেন। পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার খায়রুল কুরুনের সজীবতা উনি ফের জাগিয়ে তুলবেন। পরশ পাথর তুল্য হবে উনার মুবারক ছোহবত। উনার আওলাদ পাক উনারা এবং উনার খলীফা আজমাইন উনারা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার মেহমান হবেন।” সুবহানাল্লাহ!
সত্যিই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ভবিষ্যদ্বাণী মুবারক এবং পবিত্র ইলহাম শরীফ উনার আলোকে ৯৭১ হিজরী শরীফ উনার ১৪ই শাওওয়াল শরীফ কাইয়্যুমে আউওয়াল, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পাক-ভারত উপমহাদেশের পবিত্র সিরহিন্দ শরীফ উনার মাঝে তাশরীফ মুবারক আনেন। সুবহানাল্লাহ!
সংক্ষিপ্ত সাওয়ানেহ উমরী মুবারক:
আকবর নিদারুণ মর্মপীড়া ও দৈহিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়। অবশেষে ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ ঈসায়ী সন পর্যন্ত সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজত্বের অবসানে ১৬০৫ ঈসায়ী সনে আকবরের মৃত্যু হয়। কিন্তু সে তার আদর্শ সঞ্চারিত করে যায় বাদশাহ জাহাঙ্গীরের মন ও মননে। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তার আটত্রিশ বছরের পুত্র জাহাঙ্গীর মোঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এক পর্যায়ে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, আসিফ খান এবং অন্যান্য রাজন্যবর্গ ও আমলাদের সুপারিশে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জাহাঙ্গীর কারাবন্দি করেন। এ কারাবাসকে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি- নির্জনতায় উনার মর্যাদা ও মর্তবা উত্তরণের অনুকূল ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সুদীর্ঘ দু’বছর কারাবাসকালে উনি নিয়ামতপূর্ণ ছোহবত দান করে অনেক কারাবন্দিকে তিনি হিদায়েতের পথে এনেছেন। এরই মাঝে উনার অসংখ্য মুরীদ ও খলীফার মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উনাকে গোয়ালিয়ার দুর্গ থেকে মুক্তি দিয়ে রাজ দরবারের অন্তঃপুরে নজরবন্দি করে রাখেন। অবশেষে বিজয় সূচিত হয় তখন, যখন সম্রাট জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে উনার কাছে মুরীদ হন।
সম্রাট আকবরের সময়ে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বাস্তবায়িত হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে মানসিক দিক দিয়ে পর্যুদস্ত জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে কারাবাস থেকে মুক্তি দিয়ে উনার সাক্ষাৎ লাভের অনুমতি প্রার্থনা করেন। সাক্ষাৎ দানের পূর্বে তিনি যেসব শর্ত আরোপ করেছিলেন তা হলো-
(১) রাজ দরবারে তা’যীমী সিজদা প্রথা রহিতকরণ
(২) সকল মসজিদের পুনঃনির্মাণ
(৩) জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন
(৪) পবিত্র ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য কাজী ও মুফতী নিয়োগ
(৫) সকল বিদয়াত কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ;
(৬) গরু যবেহ করার উপর নিষেধাজ্ঞা রহিতকরণ;
(৭) সংস্কার আন্দোলনে সকল কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে মুক্তিদান।
সম্রাট জাহাঙ্গীর সকল শর্তই মেনে নিয়ে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ হন এবং উনার উপদেশমতো সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। উনার উপদেশেই জাহাঙ্গীর শাসননীতিতে পবিত্র ইসলামী আইন সংযোজন করেন। জাহাঙ্গীর শেষ জীবনে প্রায়ই বলতেন, “আখিরাতে নাজাত পেতে পারি, এমন কোনো কাজ (আমল) আমি করিনি। তবে আমার কাছে একটি সনদ আছে, আখিরাতে আমি তা মহান আল্লাহ পাক উনার সমীপে পেশ করবো। সে সনদ এই যে, একদিন হযরত শায়েখ আহমদ ফারুক্বী সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আমাকে বলেছেন- যদি মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাকে সম্মানিত জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দান করেন, তবে আপনাকে ছেড়ে যাবো না।” সুবহানাল্লাহ!
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ জীবনে পবিত্র সুন্নত উনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক হাছিল করেন। মানুষের মাঝে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র সুন্নত অনুসরণের স্পৃহা জাগিয়ে তুলে তিনি অবলুপ্ত সকল সুন্নত মুবারক যিন্দা করেন। এ জন্য উনাকে বলা হয় ‘মুহইউস সুন্নাহ’।
পবিত্র সুন্নত উনার পরিপূর্ণ অনুসারী এবং মহান আল্লাহ পাক উনার যমীনে সুন্নত জিন্দাকারী হাজার বছরের মুজাদ্দিদ- হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি উনার বড় সাধ, উনার কর্মময় জীবনাবসানের সর্বশেষ কাজটিও যেন পবিত্র সুন্নত উনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। তিনি আপনজন, খলীফা ও মুরীদগণকে ডেকে বললেন, “নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তেষট্টি বছর বয়স মুবারকে নশ্বর পৃথিবী থেকে মহান আল্লাহ পাক উনার দীদারে প্রত্যাবর্তন করেন।” অবশেষে সময় ঘনিয়ে এলো। তেষট্টি বছর বয়স মুবারকে পবিত্র বিছালী শান মুবারক প্রকাশ করে আমল ও ক্ষমতা বহির্ভূত পবিত্র সুন্নত অনুসরণের উনার এই অন্তিম বাসনাকে মহান আল্লাহ পাক তিনি পূর্ণতা দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! হিজরী ১০৩৪ (ইংরেজি ১৬২৪ সাল) পবিত্র ২৮শে ছফর শরীফ তিনি পবিত্র বিছালী শান মুবারক প্রকাশ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন)